চলছে একুশে বইমেলা ২০১৮। প্রতিদিনই মেলায় প্রকাশ পাচ্ছে নতুন নতুন বই। আর এই মেলায় প্রকাশ হয়েছে শামশাম তাজিলের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আলিফ এক মূর্খের ফিকির’। প্রকাশিত কবিতার বই, কবিতা, রাজনীতি, কবিতা বিষয়-আসয়, প্রবণতা ইত্যাদি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। এই সময় নিয়ে আশাবাদী। যদিও শঙ্কা তাকে ছাড়ে না। সময়কে তিনি দেখেন কালেক্টিভ করে। ‘আমার’ না বরং ‘আমাদের’ বলতে তিনি পছন্দ করেন।
কেমন আছেন?
ভালো আছি।
দ্বিতীয় বই আসলো। প্রকাশনা বিষয়ক অভিজ্ঞতা কেমন?
প্রকাশনা বিষয়ক অভিজ্ঞতা আসলে তেমন কিছুই নাই! ‘বই প্রকাশ করতে চাই’ এমন এক স্ট্যাটাসের বদৌলতে তিনজন প্রকাশক যোগাযোগ করেন। প্রথম যোগাযোগ করেছিলেন ঋজু প্রকাশ। তাদের প্রকাশনা কেমন জানা না থাকায় কথা তেমন অগ্রসর হয়নি। যদিও তাদের আগ্রহের কমতি ছিল না। জেব্রাক্রসিংও বই প্রকাশ করতে চেয়েছিল; চৈতন্য আগে চাওয়ায় তাদেরকেই দিই। (আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে! হা হা) চৈতন্য বই কত ফর্মার হবে জানতে চান। সেই সাথে পাণ্ডুলিপি দিতে বলেন। আর আমি সাইফ সিরাজ ভাইয়ের সহযোগিতায় প্রচ্ছদ পেয়ে যাই। সবকিছু চৈতন্যে পাঠিয়েও দেই। আমার কাজ এই পর্যন্তই। এখন বিপণন তাদের। যদিও আমার বই নিয়ে তাদের প্রচারণা তেমন চোখে পড়ে নাই! ফেসবুকে নিজে বই নিয়ে স্ট্যাটাস পয়দা করছি নিয়ম করেই!
শুভার্থী আর বন্ধুদের কেউ কেউ বই নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, এইটা ভালোলাগে। আর ভালোলাগাকে অস্বীকার করি না। প্রথম বই নিয়ে উচ্ছ্বাস ছিল। এবার আছে আশঙ্কা!
প্রথম বই ‘আদম পাহাড়’ এবার ‘আলিফ এক মূর্খের ফিকির’ এমন নাম কেন নির্বাচন করলেন?
দুইটা বইয়েরই নাম নির্বাচন করাটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। খুব ভেবে চিন্তে যে করেছি তা না। আদম পাহাড় কবিতাটার ভাবনা এক দোকানে আড্ডা দিতে দিতে পাওয়া। তখনি মনে হয়েছিল বই করলে এই নামে করব।
আর ‘আলিফ এক মূর্খের ফিকির’ নিয়ে যদি বলি, এই কবিতাটা লেখার পর তার জন্য একটা নাম খুঁজছিলাম। যে দুঃস্বপ্ন নিয়ে কবিতা লেখা তার ব্যাখ্যা জানার আকুতি রয়েছে নামটার ভেতর! কেউ কেউ মুসলমানিত্ব খুঁজতে যান বইগুলোর নামকরণে। আমি তা ভেবে করিনি। তা যে নেই সেটাও হয়তো নয়!
আপনার কবিতায় সেমিটিক ধর্ম, মিথ ইত্যাদি বেশ ভালো ডিল করেন বলেই আমার মনে হয়েছে। সেমিটিক ধর্ম দর্শন মিথ ইত্যাদির দিকে কেন মনোযোগী হলেন?
রামায়ণ, মহাভারত বেশ বড় হয়ে পড়েছি। আর দেখেছি বাংলা ভাষা ও কবিতায় তাদের প্রভাব। অল্প বয়সে না পড়ার বেদনা বয়ে বেড়াই। তেমন বেদনা ছিল বুদ্ধদেব বসুরও। তিনি ২২ বছর বয়সে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের রূপকথা পড়েছিলেন। বাঙালি মুসলমানেরা তাদের ধর্ম নিয়ে প্রচুর উপকথায় আস্থাশীল!
কিন্তু কবিতা পড়তে গিয়ে দেখেছি, এখনকার কবিরা প্রায় সচেতনভাবেই নিজ ধর্মের উপকথাগুলো এড়িয়ে চলেন। হয়তো তারা হট্টগোল চান না! আমি ভালোবেসে সেইসব নিয়ে কয়েকটা কবিতা লিখেছি। কবিতা ধর্মগ্রন্থ না, কাজেই ভয়হীনভাবেই সেইসব নিয়ে লেখা যায়।
এলিয়টের Waste land পাঠের অভিজ্ঞতাও আমাকে এইসব নিয়ে কবিতা লেখতে প্রেরণা যুগিয়েছে।
আপনার কবিতার ভাষা আপনাদের সময়ের কবিদের তুলনায় সহজ। মানে যোগাযোগ সহজ। তো এমন সহজবোধ্য ভাষা কেন পছন্দ করলেন? জাত যাবার ভয় কাজ করে না?
কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠক তার আপন অভিজ্ঞতার স্বাদ নেয়। পূর্বঘটিত বিষয়ের সঙ্গ কবিতাকে মিলিয়ে পাঠ করে। এই অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও। সেটা মাথায় রয়েছে। আমি আপন অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে পারি না। স্বতঃস্ফূর্ততায় আস্থা রাখি। আর স্বতঃস্ফূর্ততা মূলতই সহজ!
জাত যাবার ভয় তো তার, যে জাতে উঠেছে! আমার সেই ভয় নাই।
সম্প্রতি এক কবির একটা কবিতা পোস্ট করে বেশ সমালোচিত হলেন। আপনি জানতেন প্রতিক্রিয়া ভালো হবে না। তবু এই দায় কেন টানলেন?
কবিতাটা প্রায় এক বছর আগে শেয়ার করা। তখন নিশ্চয়ই আমি কারো ভবিষ্যৎ কর্মের দায় টানার জন্য কবিতা শেয়ার করিনি। আমি তো খাজা খিজির নই! যার কবিতা সম্প্রতি তার একটা স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে অনেক কিছুই ঘটে গেলো। সেইসব অনেকের চোখেই পড়েছে। আর আমার শেয়ার করার ব্যাপারটা যিনি সামনে এনেছেন তিনি এইটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েই করেছেন। কাউকে অপছন্দ করতে চাইলে অজুহাত না খুঁজলেও হয়। কিন্তু কাউকে হত্যা করতে চাইলে যা প্রয়োজন তা হল, যাকে হত্যা করতে চান তাকে একটা বাজে বিশেষণে বিশেষিত করা। যিনি আমাকে নিয়ে এই কাজটা করেছেন তার সাথে আমার সম্পর্ক যথেষ্ট ভালোই ছিল ভার্সিটিতে থাকার সময় থেকেই, এমনই তো জানতাম! বাঙালি একজনের দোষ আরেকজনের ওপরে চাপিয়ে দিতে ওস্তাদ, সেইটা আবারও জানলাম।
তবে এইটাও জানিয়ে রাখি, যিনি আমার সঙ্গে এমনটা করেছেন তিনি আত্মপরিচয় পর্যন্ত গোপন করে চলেন। তার সেইসব পরিচয় গোপনই থাকুক। যদিও আমি জানি অনেক কিছুই। তবু সেইসব প্রকাশে আগ্রহ নাই।
আপনি রাজনীতি করতেন। রাজনীতি সচেতন। আপনার বাম রাজনৈতিক আইডেনটিটি এবং ধর্ম-আইডেনটিটি দুইটাই আপনি ধারণ করেন বলেই দেখা যায়। তো, কবিতা বা যাপনে এই দ্বৈততা কেমন করে ডিল করেন?
রাজনীতি এখনো করি। যদিও কোনো সংগঠনকে আর সমর্থন করি না। এইটাও চিন্তার একটা পর্যায়। চিন্তার মিল পেলে সংগঠন আবারও করতে পারি। সমাজতন্ত্রী রাজনীতিই আমাকে শিখিয়েছে নিজস্বতা ভুলে না যেতে। আত্মপরিচয় বহন করতে। এও শিখেছি, ধর্মের সাথে আদতে সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনীতির বিরোধ নাই। যারা বিরোধকে উস্কে দেন তারা না ধর্মের পক্ষে, না সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে। তারা বিরোধ জারি রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেন। এইটা এখনকার সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার দর্শন। আমাদের ধর্মওয়ালারা সমাজকে বুঝুক। আর সমাজ পরিবর্তনকামীরা সমাজের মানুষের আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করুক।
দ্বৈততা অস্বীকার করব না, তবে তারা মিলনাত্মক দ্বৈতসত্তা।
দুই পা নিয়ে যেমন সহজে চলাফেরা করি, ভিন্ন চিন্তা নিয়ে কাজ করতেও আমি তেমনই সহজ অনুভব করি। আর একজন ব্যক্তি মানুষকে পরিবারের ভেতরেই তো একাধিক পরিচয় নিয়ে বাঁচতে হয়! তাতে জীবনযাপন বিঘ্নিত তো হয়ই না, বরং কখনো কখনো আরও সুন্দর, উপভোগ্যও হয়।
নন্দিত হবার বাসনা আর নিন্দিত হবার ভয়- মানুষের এই দুই সাধারণ প্রবণতা কেমন করে সামলান? আপানার মধ্যে তো একটা চাঁছাছোলা ব্যাপার আছে!
নন্দিত হবার বাসনা নাই। নিন্দার ভয় আছে যদিও। আর যেহেতু নন্দিত নই এইসব প্রবণতা সামলানোর দায়ও নাই। তবে নানা কারণেই নিজেকে গুটিয়ে রাখি। যা কিছু উচ্চারণ করি, তার অধিক অনুচ্চারিত থেকে যায়। ভয় রয়েছে তো!
‘আলিফ এক মূর্খের ফিকির’-এ ফিরে আসি। এই কবিতাগুলো কেমন? বিষয়বস্তু ভাষা ইত্যাদি কেমন?
আলিফ এক মূর্খের ফিকিরের কবিতাগুলো আশাবাদী হবার চাইতে বরং শঙ্কিত করে। ভাষা আদম পাহাড় থেকে দূরে যায় নি, তবে বিষয়ের ভিন্নতা আছে। স্বপ্ন ঘুম মৃত্যুচিন্তা প্রেম পরিবার রাজনীতি ধর্ম এইসব নিয়েই এগিয়েছে এর কবিতাগুলো।
কবিতার কাছে প্রত্যাশা কী? আপনার এবং আপনার সময়ের কবিতাকে কেমন করে দেখেন আপনি?
কবিতা পড়ে যেন ঝিম ধরে যায়, তেমন কিছু কবিতা লেখতে চাই। ‘আমার সময়’ এইভাবে আমি দেখতে চাই না। ‘আমাদের সময়’ বলতেই স্বস্তি বোধ করি। যে কোনো কিছুকেই দেখতে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। আমাদের সময়ের কবিতা নিয়ে বলতেও সেইটা দরকার। সময় যাক। তবে আমাদের সময়টা নিঃসন্দেহে উৎপাদনশীল। একটা চাওয়া কবিরা আরও জনসম্পৃক্ত হোক। আরও রাজনীতি সচেতন। আরও একটু সাহসী।
ধন্যবাদ…
আপনাকেও ধন্যবাদ। সুন্দর থাকুন।
আলিফ-এক মূর্খের ফিকির
শামশাম তাজিল
প্রচ্ছদ : ওয়ালিউল ইসলাম
নামলিপি : সাইফ সিরাজ
প্রকাশক: চৈতন্য