না খেয়ে, ঘুমিয়ে-না ঘুমিয়ে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় আপাতত যাযাবর জীবনযাপন করছেন শত শত শিক্ষক। পৌষ মাসের শেষ প্রায়, রাতে হু হু করে বইছে হিম বাতাস এর মধ্যেই পিঠের নিচে পলিথিন শিট, খবরের কাগজ আর গায়ের উপর পাতলা কম্বল টেনে কোনমতে রাত পার করছেন এমপিওভুক্তির দাবিতে আমরণ অনশনরত শিক্ষকরা।
অনশনের পঞ্চমদিনের দুপুরে একটি কম্বল ভাজ করতে করতে খুলনার আল আমিন মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক বাহারুল আলম জানান: এখানেই হাসপাতাল থেকে ফিরে রাতে ঘুমিয়েছিলেন নন -এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বিনয় ভূষণ রায়। শত শত সহকর্মীকে রেখে তিনি হাসপাতালে ঘুমাতে পারেননি।
প্রাকৃতিক প্রয়োজনে দিনের বেলার ভরসা শিক্ষাভবনের টয়লেট। ভবনের মসজিদেই অজু করে নামাজ আদায় করছেন শিক্ষকরা।
রংপুরের রবার্টসনগঞ্জ স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক এম আলীম বলেন: শীতে-মশার কামড়ে, ড্রেনের গন্ধের মধ্যে রাত কাটাচ্ছি। দিনে শিক্ষাভবনের টয়লেট ব্যবহার করতে পারছি, কিন্তু রাত দশটার পর সেটাও বন্ধ হয়ে যায়, নামাজ পড়াও হচ্ছে ভবনের মসজিদে। এদিকে বাড়িতে ১৫ মাসের মেয়েকে রেখে এসেছি। গতকাল মোবাইল বন্ধ ছিল, বাড়িতে কথা হয়নি।
দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষদের সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। কারণ মোবাইলফোনে চার্জ দেয়ার সুযোগ নেই।
পটুয়াখালীর একটি কলেজের বাংলার প্রভাষক এম এ আওয়াল বলেন: অনশন করার আগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে ২৬ তারিখ ঢাকার আসার পরদিন ফোন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এর ওর মোবাইল চেয়ে ফোন করছি। এখানে না খেয়ে আছি আমরা। তবুও সরকারের সহানুভূতি, সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিশ্রুতি পাচ্ছি না।
এমন পরিস্থিতিতে অনশনের পঞ্চম দিন দুপুর পর্যন্ত একশ জনেরও বেশি শিক্ষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেছেন। প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাথে ত্রিশ জনেরও বেশি শিক্ষকের শিরায় স্যালাইন চলছে। সরকারের টনক না নড়লেও আমরণ অনশনে শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বৃহস্পতিবার অনশনস্থলে সংহতি জানাতে আসেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. ফাহমিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান।
সংহতি জানানোর পর তানজিম উদ্দিন খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পেরেছি এই শিক্ষকদের জন্যই। অথচ তারা বছরের পর বছর বেতন পাচ্ছে না। তাই দায়বদ্ধতা এবং বিবেকবোধ থেকেই সংহতি জানাতে আসা।
বার বার শিক্ষকদের রাজপথে নেমে আসা দেশের উন্নয়নকে ঠুনকো করে দেয় বলে মনে করেন অধ্যাপক ফাহমিদুল হক।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: শিক্ষক সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে আমরা এখানে সংহতি জানাতে এসেছি। আমি হয়তো সুবিধাজনক অবস্থায় আছি, রেগুলার বেতন-ভাতা পাচ্ছি। এটা না থাকলে আমার কী হত এটা আমি অনুধাবন করতে পারি। শিক্ষাখাত অবহেলিত বলেই বার বার শিক্ষকদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে। শিক্ষকদের যে মর্যাদা পাওয়া উচিৎ এবং শিক্ষাখাতে যে বিনিয়োগ হওয়া উচিৎ তা হচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ ছাড়া একটি দেশ কিভাবে মধ্যম আয়ের অর্থনীতির দেশে যেতে চায় সেটা আমি বুঝতে পারি না। এটা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে। যারাই উন্নত অর্থনীতিতে গিয়েছে তারা শিক্ষায় বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। অথচ এদিকে আমাদের মনোযোগ নাই, এই হতাশা তারই চিত্র।
শিক্ষকদের পর সংহতি প্রকাশ করেন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়া। তিনি বলেন: প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আপনারা শিক্ষক সমাজের এই দাবির প্রতি সম্মান দেখাবেন আশা করি। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী ২ ডিসেম্বর আশ্বাস দিয়েছিলেন: শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি হবে, সেজন্য একটু সময় লাগবে। এই জন্য নীতিমালা করা হবে। প্রসিডিউরের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
এই সময়ক্ষেপণ নিয়েই অনশনরত শিক্ষকদের আপত্তি। কবে নাগাদ তাদের এমপিওভুক্ত করা হবে সেই সুনির্দিষ্ট সময় জানতে চান তারা, চান প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এ বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত নির্দেশনা। এর আগ পর্যন্ত অনশন চলবে বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার।