২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার প্রশংসিত কিছু পোস্টার:
মাটির প্রজার দেশে
কমলা রকেট
স্বপ্নজাল
দেবী
গেল বছরে ইরানে একটি সিনেমা মুক্তি পায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই ছবির প্রচারণার জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় টাঙানো হয় সিনেমার পোস্টার। সিনেমার নায়ক কে, নির্মাতা কে কিংবা সিনেমায় নায়িকা আছে কি নেই, এসব না দেখেও শুধুমাত্র পোস্টারটি দেখেই নাকি সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে শত শত মানুষ। পাবলিকের এই স্রোত ঠেকাতে নাকি হিমশিম খেয়েছিল সিনেমা হলটির নিরাপত্তা কর্মীরাও। এ পর্যন্ত পড়ে কি ভাবছেন? নিশ্চয় ভাবছেন, সিনেমার পোস্টারটিতে এমন কিছু ছিল যা দেখে মানুষ সিনেমাটি দেখতে আসে? নান্দনিকতায় ঠাসা ছিল পোস্টারটি? জীবনের কোনো গূঢ়অর্থ ছিল পোস্টারে? তবে জেনে রাখুন, পোস্টারটি নান্দনিকতার জন্য নয়, কারণ সিনেমার নাম ছিল ‘কর্মী চাই’!
ইরানের সিনেমার পোস্টারটিকে রিয়েল লাইফ জোকস হিসেবে নিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থেই সিনেমা হলে দর্শক টানতে একটা সময় পোস্টারের ছিল এমন জোর। কথায় আছে, ‘আগে দর্শনধারী, তারপর গুণ বিচারী’!
সিনেমা হিট করতে পোস্টার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না রাখলেও, একটা সিনেমা সম্পর্কে প্রথমেই কিছুটা ভাবতে সুযোগ করে দেয় পোস্টার। প্রথম দর্শনে সিনেমার পোস্টার যদি কারো মনে ধরে তাহলে সিনেমাটি দেখতে হয়তো ইন্ধন যোগাতে পারে সেই ভালোলাগাটুকু।
বর্তমানে সিনেমার প্রচারণায় নানা অনুষঙ্গ যোগ হলেও এক সময় প্রচারণায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতো সিনেমার পোস্টার। এমনকি পত্রিকায় সিনেমার পোস্টার দিয়েই বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দেয়া হত। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হয়তো মোশন পোস্টার, টিজার, ট্রেলারের প্রচলন শুরু হয়েছে, কিন্তু পোস্টারের যে চিরায়ত আবেদন তা অস্বীকার করছেন না এই সময়ের নির্মাতারাও। তাদের মতে, প্রযুক্তি যতো উৎকর্ষতাই দিক সিনেমা হলে যেতে প্রচারণার জন্য পোস্টারের কোনো বিকল্প নেই। যুগের সাথে হয়তো পোস্টারের নান্দনিকতা কিংবা কনসেপ্টে পরিবর্তন আসবে, কিন্তু পোস্টার বিলীন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নিকট ভবিষ্যতে দেখছেন না তারা।
গেল বছর অর্থবহ ও নান্দনিকতার বিচারে বেশ কয়েকজন নির্মাতা চ্যানেল আই অনলাইনকে তাদের পছন্দের পোস্টার নিয়ে বলেছিলেন। এরমধ্যে বেশীর ভাগই ‘ডুব’, ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ ও ‘ভুবন মাঝি’ সিনেমাগুলোর পোস্টার ডিজাইনের প্রশংসা করেছিলেন। তাদের সকলেরই প্রায় ভাষ্য ছিলো একইরকম। তাদের দাবী সিনেমায় কেমন গল্প দেখাতে চান, সেটার ইনারমিনিং তুলে ধরা হয় সেসব সিনেমার পোস্টারে।
এমন কথার সাথে মোটামুটি একমত চলতি বছরের আলোচিত ছবি ‘মাটির প্রজার দেশে’র প্রযোজক আরিফুর রহমান। সিনেমার পোস্টার নিয়ে তরুণ এই প্রযোজক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, পোস্টার সব সময়ই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পোস্টার বিষয়টা সাসটেইনেবল। এটা বিলীন হওয়ার নয়। পোস্টার যদি অর্থবহ হয়, মনে দাগ কাটে তাহলে সেই পোস্টার সারা জীবন চোখের সামনে থাকবে। যেমনটা হয়েছে ‘মাটির প্রজার দেশে’র পোস্টারের ক্ষেত্রে। অনেককেই আমি দেখেছি যারা তাদের ঘরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে এই ছবির পোস্টারটি বাঁধিয়ে রেখেছেন।
‘মাটির প্রজার দেশে’র পোস্টারটির কথা তুলে ধরে আরিফুর বলেন, ‘মাটির প্রজার দেশে’র একটি প্রমাণ সাইজ পোস্টার সম্প্রতি আমাদের দেয়ালে এঁকেছি। এই পোস্টার পুরো ছবির গল্প বলে দেয়। গল্পের সব চরিত্ররাও আছে পোস্টারে। এমনকি এটা আমাদের সমাজের ধর্মের চারপাশের মানুষগুলোর একপ্রকার প্রতিবিম্ব।
‘মাটির প্রজার দেশে’র পোস্টারের আইডিয়া ছবির নির্মাতা বিজন ইমতিয়াজ ও প্রযোজক আরিফুর রহমানের। তবে পোস্টার ডিজাইন ও ইলাস্ট্রেশন করেছেন আরিফুর রহমানের কলকাতার এক বন্ধু। যার কোম্পানির নাম ‘গ্রিনিং ট্রি’।
এদিকে প্রথম পোস্টার প্রকাশ করেই চলতি বছরে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন বছরের আলোচিত ছবি ‘দেবী’ নির্মাতা অনম বিশ্বাস। হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট সাহিত্যের মিসির আলীকে এই ছবির মধ্য দিয়ে বড় পর্দায় তুলে ধরা হয়। ছবি মুক্তির আগেই পোস্টার নিয়ে ব্যাপক হইচই পড়ে চারদিকে। ‘দেবী’র প্রথম পোস্টারে মিসির আলী রূপে চঞ্চলকে দেখা যায়। তার মুখে জলন্ত সিগারেট। উস্কো খুস্কো চুল। মাথার ভেতর থেকে পাখি উড়ছে! না, এসব মিনিংফুল কোনো কারণে আলোচিত হয়নি ‘দেবী’র প্রথম পোস্টার।
পোস্টারে ধূমপানের দৃশ্যকে প্রাধান্য দেয়ায় তামাক নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি সংগঠনগুলোর সম্মিলিত মঞ্চ বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট আন্দোলনে নামে। এমন পোস্টারের কঠোর সমালোচনা করেন তারা। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অমান্য করে ‘দেবী’ সিনেমার প্রচারণায় ব্যবহৃত পোস্টার প্রত্যাহারের দাবিও জানানো হয়। তবে এতে ‘দেবী’ মুক্তিতে কোনো বিরোধ তৈরী হয়নি। সমস্ত জটিলতা পাশ কাটিয়েই হলে রিলিজ পায় ছবিটি। প্রত্যাশার চেয়েও বহুগুণে ব্যবসাও করে নেয় ‘দেবী’। তবে দেবীর প্রথম পোস্টারটি সমালোচিত হলেও এটিকেই দেবীর অন্যতম সেরা পোস্টার বলছেন অনেকে। এমনকি ছবির নির্মাতা অনম বিশ্বাসও ‘দেবী’র প্রথম পোস্টারটিকেই অর্থবহ বলে মন্তব্য করেছেন।
দেবীর প্রথম পোস্টার নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে অনম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, দেবীর প্রথম পোস্টারটি খুব রিয়েলেস্টিক ইলাস্ট্রেশনের ছিলো। পোস্টারটি ছিলো আমার কাছে অত্যন্ত মিনিংফুল। পোস্টারে দেখা যায় চঞ্চল সিগারেট টানছে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, খুব ভাবুক একটা লুক, মাথার চুলগুলো উস্কোখুশকো। মানে মিসির আলীর যে অবয়ব সেটা প্রথম পোস্টারেই আমরা ধারনা দিতে চেয়েছি।মানে মিসির আলীর মাথা হচ্ছে একটা গোলক ধাধা, আর সেই গোলক ধাধা থেকে কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে। ব্রেইনতো আসলে যাবতীয় জিনিষ সমাধান করে, তো পাখিগুলো হচ্ছে সলোশনের প্রতীক। আমরা ওইভাবেই একটা অর্থবহ বিষয় পোস্টারে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।
‘দেবী’র দ্বিতীয় পোস্টারও ছিলো যথেষ্ট মিনিংফুল। রানুর মাঝখান দিয়ে নীলুকে বের হতে দেখি যে পোস্টারে। এরপর যে পোস্টারগুলো প্রকাশ হয় সেগুলোতে খুব একটা ভেবেচিন্তে আইডিয়া বিল্ডআপ হয়নি। সিনেমা মুক্তি এগিয়ে আসায় কমার্শিয়াল পোস্টার যেভাবে করা হয় সেভাবেই করা হয়েছে। -দেবীর পোস্টার নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন অনম বিশ্বাস।
আর প্রথম দুই পোস্টারের আইডিয়া এসেছে পরিচালক অনম বিশ্বাসের মাথা থেকেই। তবে পোস্টারের ইলাস্ট্রেশন করেছেন উন্মাদের রাজীব। এছাড়া পোস্টারে জবা ফুল সমেত ‘দেবী’ লেখাটার ক্যালিওগ্রাফি সেটা করেছেন বিজ্ঞাপন সংস্থা গ্রে’র শাফিন চৌধুরী।
প্রথম বাংলা সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’ থেকে শুরু করে সত্তর, আশি ও নব্বই দশক পর্যন্ত বাংলা সিনেমার পোস্টারের স্বকীয় একটা ভাষা ছিল। পোস্টার দেখেই সিনেমা সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবটাও কল্পনা করা যেত। বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরুর দিকের পোস্টারগুলো ছিল বেশ নান্দনিক, এবং অর্থবহ। সিনেমার পোস্টার, লেখার স্টাইল সব মিলিয়ে শিল্প মান সম্পন্ন একটা বিষয় ছিল। নব্বই দশকের পরে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ঢুকে গেলে পোস্টারেও লাগে সেই ছোঁয়া। বিশেষ করে এফডিসি নির্ভর সিনেমাগুলোর পোস্টার বাংলা সিনেমার পোস্টার হিসেবে দীর্ঘদিনের সেই ঐতিহ্য ও শিল্প মান হারায়।
যারা ব্যবসায়িক সিনেমা করেন তারা নান্দনিকতাকে চোখ বুঝেই এড়িয়ে যান। নারীদেহ সর্বস্ব একটা পোস্টার বানানোর চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষকে সিনেমা দেখতে আহ্বান করেন। অন্যদিকে যারা গল্প নির্ভর এবং বাংলার মৌলিক ছবি দেখানোর লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের ছবির পোস্টারে থাকে নান্দনিকতার ছোঁয়া। সিনেমার মতো পোস্টারেও এই বিভাজন স্পষ্ট! এমনটাই বলছিলেন আরেক নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন খান।
বইয়ের ভেতরকার লেখার প্রতিনিধিত্ব করে বইয়ের প্রচ্ছদ। তেমনি একটা সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করে পোস্টার। তাই সিনেমার পোস্টারকে অগ্রাহ্য করা ঠিক নয় বলে মনে করেন অনেক নির্মাতা। চলতি বছরে মাটির প্রজার দেশে, দেবী ছাড়াও বেশকিছু নান্দনিক পোস্টারের দেখা মিলেছে। এরমধ্যে পাষাণ, স্বপ্নজাল, কমলা রকেট, সুপারহিরো, পোড়ামন-২, বেঙ্গলি বিউটি এবং পাঠশালার পোস্টারের কথা উল্লেখযোগ্য।