দেশের প্রধান তিনটি রপ্তানিমুখী খাতের মধ্যে পোশাক শিল্প অন্যতম। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও পোশাক শিল্পে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে বহির্বিশ্বে। বেকারত্ব হ্রাস, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে গার্মেন্টস সেক্টর পালন করছে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা।
বাংলাদেশের এ শিল্পের মাধ্যমে আমাদের দেশ বিশ্ব দরবারে নতুন পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করছে। সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়ন ও পোশাক শিল্পের বিপ্লবের অন্যতম অংশীদার হিসেবে উঠে আসবে কেরানীগঞ্জের নাম।
এখানে রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি পোশাক শিল্প কারখানা এবং ২৫ হাজারেরও বেশি শোরুম। সেখানে জীবিকা নির্বাহ করছে প্রায় ১২লাখ মানুষ।
বাবুবাজার ব্রিজ পেরিয়ে আগানগর সার্ভিস রোডের পাশ দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। কেরানীগঞ্জের পূর্ব আগানগর ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস পল্লী। যা পরিবর্তন এনে দিয়েছে এখানকার অর্থনীতি ও জীবনমানে। সুলভ মূল্যে উন্নত মানের পোশাকের সরবরাহ থাকায় প্রতিদিন এখানে ভিড় করছে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা। এছাড়াও রাজধানীর আভিজাত বিপনীগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে এখানকার উৎপাদিত পণ্য।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, চাহিদামতো গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকায় অনেকদূর এগিয়ে যাচ্ছে এই গার্মেন্টস পল্লী। স্থানীয় এমপি, বিদ্যুত, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ব্যক্তিগত পদক্ষেপে এখানকার প্রয়োজনীয় বিদ্যুত পুরোটাই পাওয়া যায়। লোড শেডিং না থাকায় জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে না। এতে উৎপাদন খরচ যেমন কমছে তেমনি সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হচ্ছে। আর এসব কারণে ব্যবসায়িক খ্যাতি বাড়ছে এ অঞ্চলের। চাঁদাবাজি, রাজনীতির প্রতিহিংসা কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার না থাকায় নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। এছাড়া সহজ শর্তে ব্যংক ঋণ তৈরি করছে নতুন উদ্যেক্তা।
শুভাঢ্যা ইউনিয়নের হাসানবাদ, মিরেরবাগ, চর-মিরেরবাগ, খেজুরবাগ, চর-খেজুরবাগ,কালীগঞ্জ, চরকালিগঞ্জ, কৈবর্ত্যপাড়া, চরকুতুব, চুনকুটিয়া,শুভাঢ্যা এবং আগানগর ইউনিয়নের পুর্ব আগানগর, বাঘাবাড়ি, ইস্পাহানি, নতুন শুভাঢ্যা, আমবাগিচা, ইমামবাড়ি, কদমতলী গলচত্বর এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে কারখানা।
এসব কারখানায় জিন্স প্যান্ট ছাড়াও তৈরি হচ্ছে পায়জামা-পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, টি-শার্ট, শার্ট, ফতুয়া, বোরখা ও শীতবস্ত্র। তৈরি হচ্ছে আমেরিকার বিখ্যাত ব্র্যান্ড লেভাইজ, বু কালেকশন, ইতালির ভারসেস, আরমানি, চীনের কসমো, পিয়ারিম্যান ও লুসিলংসহ বিদেশের অনেক নামিদামি ব্রান্ডের পোশাক। ডেনিম (জিন্স) ক্ষেত্রে রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এই গার্মেন্টস পল্লী। দেশি-বিদেশি নতুন কাপড়ের পাশাপাশি বড় বড় গার্মেন্টস কারখানার ঝুট থেকেও তৈরি হচ্ছে এখানকার পোশাক।
দেশের বৃহত্তম বস্ত্রের পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী গার্মেন্টস পল্লী। দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাকের প্রায় ৭০ ভাগ চাহিদা মেটানো হচ্ছে এখান থেকে।
গুদারাঘাট এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য পোশাক কারখানা, দোকানপাট ও পাইকারি মার্কেট। এখান থেকে নদীপথে পণ্য পরিবহনও বেশ সহজ। আগারগরের ঠিক পশ্চিমেই বাংলার জাপানখ্যাত জিনজিরা, মুঘল আমলের স্মৃতিবাহী ভগ্নপ্রায় জিনজিরা প্রাসাদ। এসব স্থানের ঐতিহাসিক পরিচিতি কালের বিবর্তনে চাপা পড়ে গেলেও বিভিন্ন শিল্পের প্রভূত উন্নয়নে এখন জেগে উঠছে আবার ও নতুন করে। ঢাকার কেরানীগঞ্জের এনইএন নূর সুপার মার্কেটে ছোটদের পোশাকের পাইকারি দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় সবসময় লেগেই থাকে। এই ভিড়ের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা মালামাল কিনছেন সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস পল্লীতে।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি স্বাধীন শেখ বলেন, ‘আমাদের এখানে সব ধরনের পোশাক তৈরি ও বিক্রি হয় পাইকারি দরে। এখানকার পাঞ্জাবী ও জিন্স প্যান্টের মান ও বিক্রি সবচেয়ে বেশি। দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ পাঞ্জাবী ও জিন্স প্যান্টের চাহিদার জোগান দিয়ে থাকে এই মার্কেট।’
ব্যবসায়ীরা জানান, কেরানীগঞ্জের সকল মার্কেটকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। নিরাপত্তা ও অনান্য সামাজিক সুবিধা থাকায় ব্যবসায় লেনদেনে জটিলতা হচ্ছে না।
স্থানীয় গার্মেন্টস মালিক শেখ জানে আলম জানান, ‘১০ বছর আগেও বিদেশি কাপড় বিক্রি বেশি হলেও এবার এখানকার কাপড়ের মান ভালো হাওয়ায় দেশি কাপড়ের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। আগা নগর- শুভাঢ্যার নাম না বললেও রাজধানীর পলওয়েল, বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সসহ অভিজাত বিপণী বিতানগুলোতে আমাদের তৈরি জিন্স প্যান্টসহ অন্যান্য কাপড় পাওয়া যাচ্ছে।’
কথা হয় আরেক ব্যবসায়ী নেতা ও কেরানীগঞ্জগার্মেন্টস ব্যবসায়ীও দোকান মালিক সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ শেখ কাউছারের সাথে, তিনি জানান, ‘বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশে এখানকার পোশাকের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও যাচ্ছে এখানকার উৎপাদিত শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবী ও থ্রি-পিস।’
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে পোশাক রফতানি থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিজিএমইএ। বিশ্ব পোশাক বাজার এখন ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশ এর মাত্র ৫ শতাংশ সরবরাহ করে। এ হার ৮ শতাংশে উন্নীত করতে পারলেই ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। এই অর্জনের গর্বিত অংশীদার হতে চায় পোশাক শিল্পের বিপ্লবে দাবিবার কেরানীগঞ্জ ।