চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পূর্ণিমা ও মিশা সওদাগরের ‘ধর্ষণ’ সংলাপ!

‘আপনি সিনেমায় কতবার ধর্ষণ করেছেন?’
‘যতবার আমাকে পরিচালক বলেছে, ততবার করেছি’
‘কার সঙ্গে ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয় করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?’
‘মৌসুমী ও পূর্ণিমার সঙ্গে।’
‘হাঃ হাঃ হাঃ!’
উপরের সংলাপগুলো একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের দুই অভিনয় শিল্পীর। অনুষ্ঠানে খল অভিনেতা মিশা সওদাগরকে প্রশ্ন করেন চিত্রনায়িকা-উপস্থাপিকা পূর্ণিমা।  গণমাধ্যমে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে এমন সংলাপে বোঝা যায় বাংলাদেশে বোধ এবং রুচির দুর্ভিক্ষ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! হায়রে আমার টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আর হায়রে আমার অভিনেতা-অভিনেত্রী! এমন দেশে ধর্ষণের ‘বাম্পার’ চাষাবাদ হবে, এক বছরের শিশু ধর্ষিত হবে-অপহৃত ধর্ষিত মেয়ের লাশ ধান ক্ষেতে পাওয়া যাবে-এ আর বিচিত্র কি!

পূর্ণিমা আর মিশা সওদাগরের মতো অভিনয় শিল্পীর কাছে বেশি কিছু প্রত্যাশা করাটা হয়তো অন্যায়, বাড়াবাড়িও বটে।  তাদের মধ্যে সেই শিক্ষা, রুচি, বোধ তৈরি না-ই হতে পারে। পরিবেশ-পরিস্থিতি হয়তো তাদের উন্নত ‘বোধ’ তৈরির ক্ষেত্রে অনুকূল ছিল না! কিন্তু যারা টেলিভিশন চালান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকেন, তারাও কি ‘ধর্ষকামী মনোভাব’ থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি? ন্যূনতম ‘হিতাহিত জ্ঞান’ ছাড়াই কি আজকাল টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগে চাকরি পাওয়া যায়? নাকি তারাও মিশা সওদাগরের মুখে ‘মৌসুমী ও পূর্ণিমার সঙ্গে’ ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয় করে স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার বয়ান শুনে পুলকিত হন? তাই এ ধরনের অসংবেদী সংলাপকে টেলিভিশনে প্রচারের উপযোগী মনে করেন?

আরটিভি কর্তৃপক্ষ পূণির্মাকে দিয়ে ধর্ষণ নিয়ে হাসাহাসি করিয়ে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে ধর্ষণ খুবই হাসির ঘটনা, এটা নিয়ে হাসাহাসি করা যায়! এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা? ধর্ষকদের সঙ্গে আমরাও যদি আমাদের বোধ-বুদ্ধি-বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়ে পথ চলি, তাহলে এদেশের মেয়েসন্তানরা কী ভাবে পুরুষ নামক কিছু অমানুষের লালসা থেকে মুক্তি পাবে? ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ থেকে তাদের রেহাই মিলবে কীভাবে?

আমাদের দেশের অধিকাংশ সিনেমায় ধর্ষণকে একটি বিনোদন দৃশ্য হিসেবেই দেখানো হয়।  এভাবে ধর্ষণকে খুব স্বাভাবিক করে তোলার ফলে ধর্ষণের মতো অত্যন্ত একটা ভয়ঙ্কর অপরাধের প্রতিক্রিয়া দেখানোর ব্যাপারেও কিন্তু আমরা অসার হয়ে পড়ি। আর এর বিষফল ফলে সমাজ দেহে। মহামারির মতো বেড়ে চলে ধর্ষণ। শিশু, কিশোরী বৃদ্ধা-কেউ এই ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পায় না, পাচ্ছে না!

আমাদের সিনেমার কলাকুশলীরা ‘বিবেক ভর্তা’ ছাড়া জাতিকে তেমন কিছু উপহার দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।  তাদের যৌথ অবিমৃষ্যকারী ভূমিকার কারণে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন একটি বিনোদনের উপকরণে পরিণত হয়েছে। অন্যসব দেশে সিনেমা জগতের মানুষেরা ইদানীং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। সেই যুগে আমাদের পূর্ণিমা আর মিশা সওদাগরের ধর্ষণ নিয়ে ‘হাস্য-রস’ করছেন। যেন, এটা খুবই একটা উপাদেয় জিনিস! এই ঘটনাটি জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যের। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে চলে আসা যৌন অপরাধের ‘স্বাভাবিকীকরণ’কে প্রশ্নবিদ্ধ করা, এই অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যখন যে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পরম কর্তব্য, তখন একটি গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে যখন ‘হাসাহাসি’ করা হয়! তখন প্রশ্ন জাগে, আসলে আমরা কি সামনে চলেছি, না পেছনে?বিষয়টি নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে সমালোচনার পর নায়িকা পূর্ণিমা বলেছেন. ‘আমি যদি কোনো ভুল বা অন্যায় করে থাকি বা কারও মনে আঘাত করে থাকি এই বিষয়টা তুলে এনে, আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’ ক্ষমা চাওয়ার ঢং দেখলেও মেজাজটা বিগড়ে যায়! ‘আমি যদি কোনো ভুল বা অন্যায় করে থাকি’ অর্থাৎ তিনি এখনও নিশ্চিত নন যে তিনি অন্যায় বা ভুল করেছেন! যেন যারা প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা বলছেন, ভুল তাদেরও হতে পারে!

আসলে আমরা এক ভয়াবহ বিকারের মধ্যে বসবাস করছি। মাত্র কয়েকদিন আগে অভিনেতা মোশাররফ করিম এক টিভি অনুষ্ঠানে ‘ধর্ষণের কারণ পোশাক নয়’ এমন এক মন্তব্য করে ফেঁসে গিয়েছিলেন। পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী ধর্মবাদীরা মোশাররফ করিমের বিরুদ্ধে হামলে পড়েছিলেন। এদেশে এখন যেন উল্টো স্রোত বইছে। এখানে ধর্ষণ এখন টিভি অনুষ্ঠানে বিনোদন বা হাসাহাসির বিষয়! এখানে ধর্ষণ এখন নিতান্তই যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার ব্যক্তিগত ‘সমস্যা’। তার পোশাকের সমস্যা। আচরণের সমস্যা! যুক্তি-বুদ্ধি-কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে আমরা এক অদ্ভুত বিশ্বাসের জগতে বাস করছি।  এই ‘বিশ্বাস’ কেবলই নারীকে ‘ভোগ’ করতে, ‘দখল’ করতে, ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে শেখাচ্ছে। আর একটি শিক্ষা ইদানীং ব্যাপক মাত্রায় চালু হয়েছে তা হলো আগুনে পোড়া রোগীর মতো নারীকে কাপড়ে একেবারে আগাগোড়া মুড়ে ‘ব্যান্ডেজ’ করে ঢেকে রাখা! এর আরেক নাম দেওয়া হয়েছে ‘পর্দা!’ এই উন্মত্ততার যুগে ধর্ম হয়ে উঠেছে কামতাড়িত পুরুষের বর্ম। তাই পুরুষের চোখের ‘পর্দা’ নয়, নারীর শরীরের পর্দা নিয়ে চারদিকে এত মাতম!

পুরুষরা নারীর প্রতি এমন কামার্ত কেন হয়? পুরুষতান্ত্রিক ভাষ্য হচ্ছে: ‘উত্তেজনার বশে’ কিছু পুরুষ এমন কাজ করেন।  প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তেজনাটা তাহলে কি? বিজ্ঞান মতে, উত্তেজনা এক বিশেষ রকম অনুভূতি যা মস্তিষ্কে তৈরি হয় এবং মানুষ তার অধীন হয়ে পড়ে। উত্তেজনার বশে মানুষ কখনও নৃত্য করে ওঠে, কখনও গালি দেয়, কখনও অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পড়ে, কখনও ক্রোধে উন্মত্ত হয়। এই উত্তেজনার বশেই নাকি কিছু কিছু পুরুষ নারীদের যৌন হয়রানি করে থাকে, কখনও বা ধর্ষণও।  অর্থাৎ, এই যুক্তিতে, ‘পুরুষের উত্তেজনা’ই নারীর প্রতি যৌন হয়রানির মূল কারণ! কিন্তু এটা তো বাহ্য।  পুরুষজাতির মধ্যে এই ‘উত্তেজনা’ আনে কে? নারীর উত্তেজক পোশাক।  বহুশ্রুত যুক্তি নারী ‘উত্তেজক পোশাক’ পরে বলেই, পুরুষ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে তার উপর চড়াও হইতে বাধ্য হয়।  অতএব নারীর লাঞ্ছনার জন্য নারীই দায়ী।  প্রশ্ন হচ্ছে, ‘উত্তেজক পোশাক’কাকে বলে? উত্তেজনা তো মস্তিষ্কের ক্রিয়া। তর্কের খাতিরে যদি ধনে নেয়া হয় যে, নারীর ‘স্বল্পবাস’ সত্যই পুরুষের উত্তেজনার কারণ, তার দায় পোশাকের কেন হবে? সেই দায় তো পুরুষের মস্তিষ্কের! কিন্তু সে কথা আমাদের দেশে বলা যাবে না।  বললেও তা কেউ মানবেন না।  ধর্মের বাণী দেখিয়ে তেড়ে-ফুঁড়ে আসবে!

পুরুষতান্ত্রিক বিধানে যৌনতার অনুষঙ্গকে বহন করে চলার আবহমানকালীন অভ্যাস মেয়েদের মেনে নিতে হয়েছে বলে নিজস্ব এক সন্ত্রাসের জগতে বাঁচাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েদের অনিবার্য নিয়তি।  সে জগতে অবিশ্বাস-ধস্ত নারী, পুরুষের প্রতিপক্ষে একা নারী, মন সেখানে অস্বীকৃত-উপেক্ষিত, কেবল আছে নারীর শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে আদিমতার উল্লাস।  ভোগের সেই উৎসবে শামিল শত-সহস্র-লক্ষ জন।  নইলে ব্যক্তিগত শারীর লালসা থেকে পারিবারিক বিবাদের আক্রোশ পর্যন্ত যে-কোনও কারণেরই সহজ শিকার নারী, প্রতিশোধ স্পৃহার সহজ নিবৃত্তি ধর্ষণ কেন? আমরা মেয়েদের ভয় দেখিয়ে সারাক্ষণ ঘরের চার দেয়ালের দিকে ঠেলে দিই, বলি: মেয়ে, তুমি সাবধানে থাকো। যে কোনো সময় তুমি আক্রান্ত হতে পারো (বলি না যে, পুরুষের লালসার শিকার হতে পারো)! তুমি যতই অপাপবিদ্ধ হও না কেন, দুর্ভাগ্য নেমে আসতেই পারে যখন-তখন।  অতএব সাবধান।  নিজেকে ঢেকেঢুকে লুকিয়ে রাখো।  আমরা নানা ভাবে ধর্ষণ শব্দটিকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেছি। শ্লীলতাহানি, ইজ্জত লোটা থেকে শুরু করে নানা ঢাকা-চাপা নাম দিয়েছি জিনিসটার। আজ কিন্তু সেটা খসে গিয়েছে।  যদিও এর বিপরীত দিকও আছে। ধর্ষণ শব্দটা বার বার শুনতে শুনতে আমাদের মন এমন অসাড় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে যে এর পর একটি মেয়ে কোনও পুরুষের অবাঞ্ছিত স্পর্শ নিয়ে আপত্তি জানালে বোধহয় শুনতে হবে: তাতে কী হয়েছে, ধর্ষণ করে মেরে তো আর ফেলেনি?

অতএব ধর্ষণ কেবল নারী নির্যাতন নয়, তা বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের একটি প্রকাশ। তাই ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তার প্রতিকার করা, এর কারণগুলো অনুসন্ধান করা, কোনো ভাবেই যেন যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ প্রশ্রয় না পায় তা নিশ্চিত করা।  এটা প্রতিটি সভ্য মানুষের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

‘পূর্ণিমা’দের কাণ্ডজ্ঞানহীন হাসাহাসিতে যেন ধর্ষণের মতো গুরুতর সামাজিক অপরাধটি লঘু হয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ হতে হবে।  মনে রাখতে হবে, অশ্লীল স্থূলতা নয়, মানবিক সংবেদনশীলতা যেন আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়কে দ্রবীভূত করে!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।