সেদিন সকাল থেকেই আকাশে ছিল মেঘের ঘনঘটা, সকাল গড়িয়ে এক সময় সেই মেঘই ভেঙে পড়ে তুমুল বৃষ্টি হয়ে। প্রকৃতিকে যেন উল্টেপাল্টে ধুয়ে-মুছে দেয় সেই বৃষ্টি। তবে এদিনের বৃষ্টি শুধু প্রকৃতিকেই নয়, তার প্রশান্তির অমলিন অনুপ্রেরণা স্পর্শ করেছিল ১৪১ জন শিক্ষানবিশ পুলিশ কর্মকর্তার আগামীর স্বপ্নকেও।
স্বপ্নবোনা সেই চোখগুলো যখন সারদা পুলিশ একাডেমির আকাশসীমায় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি দেখলো, তখন উল্লাসের রঙে রাঙিয়ে নিল নিজেদেরকে। এইতো আর মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত, তারপরই শেষ হবে নতুন পুলিশ কর্মকর্তাদের দীর্ঘ ১ বছরের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য হওয়া ট্রেনিং পিরিয়ড।
৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৬ সালের ১১ জুন বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ নিতে সারদা এসেছিলেন এই কর্মকর্তারা। তার শেষ হয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর তাদের সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে।
প্রশিক্ষণ শেষে এখন তাদের একটাই লক্ষ্য দেশ আর দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করা। চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কয়েকজন শিক্ষানবিশ সহকারি পুলিশ সুপার জানিয়েছেন তাদের অনুভূতি আর আগামীদিনের স্বপ্নের কথা।
গত একবছরে তাদের সেই প্রশিক্ষণ ছিল দীর্ঘ আর কঠোর। নানা রকম পদ্ধতিতে হওয়া সেই প্রশিক্ষণের মূলমন্ত্রই ছিল শৃঙ্খলা। তাতে অংশ নিয়ে শারীরিক আর মানসিকভাবে ক্লান্ত হলেও সারদা পুলিশ একাডেমি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। গত ১ বছরে সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে পাশে থাকা মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয় নতুন পুলিশ কর্মকর্তাদের হৃদয়। তারপরও বিদায়বেলায় একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পড়েছেন কান্নায়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন দায়িত্বটাই বড় হয়ে আসে তাদের কাছে।
শাহ কামাল:
পুলিশ সম্পর্কে মানুষের যে নেতিবাচক ধারণা সেটি পাল্টে দিতে চান শাহ কামাল। তার কাছে কেউ কোন অভিযোগ নিয়ে আসলে পুরোটা মন দিয়ে শুনে তার সমাধান দিতে চান তিনি। আর সমাধান দিতে না পারলে বলে দিতে চান সমাধান খুঁজে পাবার পথ। ৩৪ তম বিসিএসে পুলিশে প্রথম হয়ে সারদা পুলিশ একাডেমির ট্রেনিং এ যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
কর্মস্থল যেখানেই হোক না কেনো সে এলাকার আপামর জনসাধারণের জন্য কাজ করে নিজেকে আস্থাবান হিসেবে গড়ে তুলতে চান।
ট্রেনিংয়ের আগে এবং পরের মানসিকতা একেবারেই ভিন্ন উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এতদিন আমরা শিক্ষার্থী হিসেবেই পরিগণিত হতাম। কিন্তু এখন যে মূল পুলিশিং সেটার সাথে অন্তর্ভুক্ত হবো।’
আর এই পাসিং আউটের বিষয়টা একেবারেই অন্যরকম। এখানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে যে শপথ পাঠ করানো হয় তার মাধ্যমে দেশের মানুষের সেবা করার অানুষ্ঠানিক সূচনা হয়।
শরীয়তপুরের ছেলে শাহ কামাল স্বপ্ন দেখেন এমন বাংলাদেশের যেখানে সম্পদ ও সুশাসনের সমান বণ্টন হবে।
সন্দীপ সরকার:
৩৪তম বিসিএসে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে বেস্ট প্রবিশনার অ্যাওয়ার্ড ( শ্রেষ্ঠ অফিসার পুরস্কার ) পেয়েছেন তিনি। কঠোর এ নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণে ১৪০ জন কর্মকর্তাকে পেছনে ফেলে প্রথম হয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা সন্দীপ ৩৪তম বিসিএসে পুলিশে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার পেয়ে আপ্লুত এ কর্মকর্তা। আপ্লুত তার পরিবার।
জনগণের বন্ধু হয়ে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চান সন্দীপ। বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার দিক থেকে আরও অনেক বেশি সমুন্নত দেখতে চান। বিশ্বাস করেন ভালো কাজই বদলে দিতে পারে অনেক কিছু।
মাহমুদা শারমিন নেলী:
৩৪তম বিসিএসের সমাপনী কুচকাওয়াজে একটি কনটিনজেন্টেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন মাহমুদা শারমিন নেলী। দায়িত্বশীলভাবে নিজের অবস্থানে থেকে কাজ করতে চান নেলী।
ময়মনসিংহের মেয়ে নেলী চট্ট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতেকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। অনার্স মাস্টার্স দুটোতেই প্রথম শেণীতে প্রথম মেধাবী এ নারী পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারণার বিষয়ে নেলী বলেন, নেতিবাচক ধারণার এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। বিপদে পড়লে সবার আগে মানুষ খোঁজ করে পুলিশকেই, চাইবো এমনভাবে কাজ করতে যাতে জনগণের মনে পুলিশের প্রতি একটা আস্থা তৈরি হয়। পুলিশের মূল কাজ নিরাপত্তা দেয়া। আর তাই নেলী স্বপ্ন দেখেন এক নিরাপদ বাংলাদেশের।
অানোয়ার শামীম:
সেদিন পাসিং আউট শেষ হবার পর সহকর্মীদের অনেক বেশি মনে পড়ছে বলে জানালেন শামীম। দীর্ঘ একবছরের এ বন্ধন সত্যিই দুচ্ছেদ্য উল্লেখ করে এ শিক্ষানাবিশ কর্মকর্তা বলেন, যেখানেই থাকি না কেনো ব্যাচমেটদের মনে পড়বে অনেক বেশি।
নিয়মিত পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের নিপীড়িত, বঞ্চিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করতে চান তিনি। স্বপ্নাতুর এ নবীন পুলিশ কর্মকর্তা সামাজিক কার্যক্রমে নিজেকে অনেক বেশি অন্তর্ভুক্ত করতে চান। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি তরুণ এ কর্মকর্তা স্বপ্ন দেখেন দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশের।
নির্মল পরিবেশে খাগড়াছড়ির পাহাড়ে বেড়ে উঠেছেন শামীম অনোয়ার স্কুল কলেজও সম্পন্ন করেছেন সেখানেই। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকাউন্টিং বিভাগে। সেখান থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে ৩৪তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে ১১তম হয়ে যোগ দেন সারদা পুলিশ একাডেমির ট্রেনিংয়ে।