পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের ফাঁদে আটকা পড়ে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছে টাঙ্গাইলের এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও মুক্তি মিলছে না। পুলিশের হুমকি আর মৃত্যুর ভয় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী যমুনা নাদীর পাড় ঘেঁষা মাদক জোন খ্যাত নলীন এলাকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম। তার ছেলে বেলাল। ২০১০ সালে ছাত্রাবস্থায় সন্দেহজনকভাবে পুলিশ তাদের বাড়িতে হানা দেয়। সেসময় পুলিশ তার কাছ থেকে কোন মাদকদ্রব্য না পেয়ে চলে যায়। পরে ভূঞাপুর থানার এক এএসআই তাকে মামলার ভয় দেখিয়ে পুলিশের সোর্স হতে বাধ্য করে বলে পরিবারটির অভিযোগ। এরপর সে পুলিশের দেখানো পথে এলাকার মাদকসেবী ও অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের লোকজনকে ধরিয়ে দেয়া শুরু করে।
মাদককে হাতিয়ার করে তার মাধ্যমে পুলিশ সপ্তাহে আদায় করতো তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। আর সোর্স হিসেবে কাজ করার পুরস্কার হিসেবে বেলাল কিছু পেত। তবে পুলিশের দেয়া মাদক বিক্রি করে একসময় সে নিজেই উঠে মাদক ব্যবসায়ী। এছাড়া উদ্ধার করা মাদক বিক্রির দায়িত্বও দেয়া হয় তাকে। এক সময় বিষয়টি তার পরিবারের দৃষ্টিগোচর হলে পুলিশের ফাঁদ থেকে তাকে বের করে আনার চেষ্টা করেন তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা। বেলাল নিজেও অসহনীয় জীবন থেকে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুলিশ।
তার অভিযোগ: পুলিশের কাজ থেকে বিরত থাকার কারণে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, নতুন নতুন মামলা ও ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। বেলাল ও বেলালের মুক্তিযোদ্ধা বাবা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান।
এ চিত্র শুধু ভূঞাপুরের বেলালের জীবনে সীমাবদ্ধ নয়। জেলার ১২টি থানা পুলিশের চিত্রই একইরকম। বেলালদের তৈরি করা অসংখ্য অসাধু পুলিশের নাম উঠে এসেছে অনুসন্ধানে। তার মধ্যে গোপালপুর-ভূঞাপুরের সংসদ সদস্য বার্ধক্যজনিত কারণে এলাকায় না আসা এবং ঘাটাইলের সংসদ সদস্য হত্যা মামলায় জেলে থাকায় অভিভাবক শূন্যতার সুযোগে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ তিন থানার কিছু পুলিশ সদস্য।
গোপালপুর থানার নলীন এলাকার লিক্সন নামের এক ভুক্তভোগী বলেন: ১৫/২০ দিন আগে বিকেলের দিকে চা খাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে কেবলই রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। এমন সময় একটি সিএনজি যোগে তিনজন আমার সামনে এসে বলে, আমরা আইনের লোক। আমরা আপনাকে সার্চ করবো। আমি তাদের সার্চ করতে দেই। কিন্তু তারা আমার কাছে কিছুই পায় না। সেসময় কিল-ঘুষি দিয়ে আমাকে জোর করে সিএনজিতে তুলে নেয়।
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় লিখিত অভিযোগকারী খোরশেদ আলম বলেন: আমার ছেলে সাব্বির গত ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ক্রিকেট খেলা শেষে বাড়ি ফিরছিল। পথে ঘাটাইল থানার কয়েকজন তাকে আটক করেন। পরে আমি ছেলের ফোন পেয়ে থানায় যাই। সেসময় আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করা হয়। না দিলে ছেলে মাদক ব্যবসায়ী বলে চালান করে দেবে বলে হুমকি দেয়। মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে রাজি হই।
পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হওয়া বেলালের স্ত্রী আলেয়া বেগম বলেন: বেলাল তাদের কাজ করে না দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে দু’জন এসআই বাড়ি সার্চ করেন, আমি তখন বাড়িতে একা ছিলাম। কোন কিছু না পাওয়ায় আমি তাদের এমন হয়রানি করতে নিষেধ করতেই তারা আমাকে শাবলের ঘা দিয়ে হত্যা করতে চান এবং অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন।
তবে যাদের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ আছে এমন সকল পুলিশ কর্মকর্তাই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা দাবি করেছেন, মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদকসেবীরা তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন।
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসলাম খান বলেন: কোন পুলিশ সদস্য যদি কোন কারণে নিরীহ মানুষদের মাদক দিয়ে হয়রানি করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের আইনের আওতায় এনে বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কেননা কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় কোনভাবেই বাহিনী নিতে পারে না। তদন্তে প্রমাণিত হলে অপরাধীরা ছাড় পাবে না।
অনশন
‘পুলিশের হামলা-মামলা’ থেকে রেহাই পেতে বেলালের মুক্তিযোদ্ধা বাবা ও তার পরিবার শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে আমরণ অনশন শুরু করে। ছেলে বেলাল, ছেলের বউ আলেয়া বেগম ও দুই নাতনীকে সঙ্গে নিয়ে অনশন শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম। পরে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে প্রশাসনের আশ্বাসে অনশন প্রত্যাহার করেন তিনি।
বেলালের বাবা আব্দুল হাকিম বলেন: গতকাল রাতে আমার ছেলের ঘরের দরজা ভেঙ্গে থানায় তুলে নিয়ে আসে। তুলে আনার সময় আমার ছেলের কাছে কোন মাদক না পেলেও তাকে মাদক ও চুরির মামলার ভয় দেখিয়ে থানায় এতে নির্যাতন করে এবং মামলা থেকে বাঁচতে এক লাখ টাকা দাবি করে। আমারা টাকা দিতে অস্বীকার করি ও বিষয়টি আমার মুক্তিযোদ্ধাসহকর্মী কয়েকজনকে জানাই। পরে রাত ১টার দিকে বেলালকে তারা ফেরত দিয়ে আমার কাছে মুচলেকা চায়।
‘প্রতিনিয়ত এই হয়রানী থেকে বাঁচতে মুচলেকা না দিয়ে আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নেই। বিকেলে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাকে টেলিফোনে আশ্বাস দিলে আমি অনশন প্রত্যার করি।’
অনশন ভাঙ্গার সময় উপস্থিত থাকা ভূঞাপুর থানার এস আই হারুন অর রশিদ বলেন, তার অনশনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ অবহিত আছে। অভিযোগ মতে কারো দোষ প্রামাণ হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে ঊর্ধতন মহল।