পুলিশের পক্ষ থেকে এবারের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা মতে, এবারের বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রায় নির্দিষ্ট কিছু মানুষ ছাড়া কেউ অংশ নিতে পারবে না। অবাঞ্ছিত কেউ যেন মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢুকে আনন্দ-উৎসবে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাখবে পুলিশ। গতবছর পহেলা বৈশাখে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার মতো কোনো কিছু যেন এবার না ঘটে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তবে আশার কথা হচ্ছে, নিরাপত্তার নামে পুলিশের এই ‘ছেঁটে দেওয়া’ নববর্ষ পালন নিয়েও মানুষের উৎসাহের কোনো শেষ নেই। প্রকৃতির উত্তাপকে থোড়াই কেয়ার করে মধ্যবিত্ত নাগরিকরা ঠিকই নিজেদের মতো করে বর্ষবরণের প্রস্তুতিতে মেতে উঠেছে। যেন বর্ষবরণ করতে না পারলে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে না পারলে, বৈশাখের দিন ইলিশ খেতে না পারলে পুরো মানব জন্ম বৃথা হয়ে যাবে! বেঁচে থাকার আর কোনো মানে থাকবে না!
পুরাতন বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমন খুবই স্বাভাবিক এবং অনিবার্য একটি ঘটনা। মহাকালের নিয়মে নববর্ষ আসবেই। পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরী যদি নিবিড় আলিঙ্গনে পুরনো বছরকে ধরে রাখতে চায়, তবু তারা সফল হবে না। আবার দুনিয়ার সব মারণাস্ত্র তাক করলেও নতুন বছরের আগমনকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। নতুন বছর অনেকটা জঙ্গিগোষ্ঠীর মতো নাছোড়বান্দা। আইনকানুন, নীতি, গণতন্ত্র, সংবিধানের দোহাই দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী সে চলে। সেদিক থেকে বিচার করলে নতুন বছরের আগমন আর পুরনো বছরের চলে যাওয়ার তেমন কোনো নতুনত্ব নেই। তাৎপর্যও বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা এ বছর ‘ভর্তা’ হয়েছে, আসছে বছর তারা বড়জোর ‘ভাজি’ হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না।
তারপরও কিন্তু পুরনো বছরের শেষে একশ্রেণির মানুষ অকারণেই হিসেব মেলানোর চেষ্টা করেন। কী পেলাম আর কী পেলাম না-এ নিয়ে ফালতু সময় ব্যয় করেন। ঘোড়ার আণ্ডা ছাড়া কোনো কিছু না পেলেও নতুন বছরে অনেকেই নতুন প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করতে চান। গেলো বছর যে ষাঁড়টা সবাইকে দাবড়েছে, আসছে বছর সে যেন শান্ত-শিষ্ট-ভদ্র হরিণে পরিণত হয়-এমন প্রত্যাশাও করেন অনেকে।
নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ এলেই কিছু লোকের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। শীতকালীন চুলকানির চেয়েও প্রকটভাবে দেখা দেয় বর্ষবরণের হুজুগ। পান্তাভাত ইলিশ খেয়ে, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শাড়ি পরে অকারণ শহরময় দাপাদাপি করাটা এখন শহুরে বাঙ্গালি মধ্যবিত্তের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। ‘একদিনের বাঙ্গালি’ সাজার সেই হুজুগে তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি আঁতেলরাও উৎসাহ যোগাচ্ছেন। এই আঁতেল শ্রেণির মধ্যে আবার নববর্ষ এলেই স্বপ্ন-প্রত্যাশার ঢেউ জাগে। তারা স্বপ্নের রঙে আগামীর ক্যানভাস রাঙিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিগত দিনে ব্যর্থতা-হাহাকার-বঞ্চনার ক্ষতে আগামী দিনের স্বপ্ন-সুখের মলম লাগিয়ে শান্তি ও সান্ত্বনা খুঁজে পেতে চান। যা জোটেনি, যা হারিয়ে গেছে, সে সব ফিরে পেতে আবার নতুন সংকল্পে বুক বাঁধার উপদেশ দেন। যদিও তা কোনো কাজে লাগে না। আর লাগবেই বা কেন? এ যুগে কে শোনে কার কথা? এ যুগে সবাই সবাইকে শিক্ষা দিতে চায়-উচিত শিক্ষা। শিক্ষা নেয়ার মতো যথেষ্ট সময় কার আছে ?
গত বছর অর্থাৎ ১৪২১-র বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অপ্রীতিকর ঘটনাকে মাথায় রেখে এবার ‘নিরাপত্তার কারণে’ বর্ষবরণে বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এর মধ্যে বর্ষবরণের সব অনুষ্ঠান বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে, মুখোশে মুখ ঢেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া যাবে না এবং ভুভুজেলা বা বিকট আওয়াজের বাঁশি বাজানো যাবে না। পান্তা-ইলিশেও নাকি আপত্তি জানানো হয়েছে। এর মধ্যে ভুভুজেলা না বাজানো কিংবা আকালের মৌসুমে শুধু শুধু ইলিশ খাবার যে ক্রেজ সেটা বন্ধ করাটা অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু বিকেল পাঁচটার মধ্যে ঘর ফেরা, মঙ্গলশোভাযাত্রায় বর্ণাঢ্য আয়োজনে নিয়ন্ত্রণ-মুক্তমনা বাঙালিকে কেমন যেন অস্বস্তির মুখে ফেলেছে। গেল বছর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটল। তার কোনো প্রতিকার করতে পারল না পুলিশ। এবার কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করার সিদ্ধান্ত হলো। এতে করে কী সমস্যার সমাধান হবে? এরপর কী বলা হবে, ঘরে বসে উৎসব করো!
এদিকে বৈশাখকে সামনে রেখে রাজধানীতে চলছে কেনাকাটার ধুম। সরকার এ বছর থেকে বৈশাখী ভাতাও চালু করেছে উৎসবের গুরুত্ব বিবেচনায়। একদিকে উৎসব ভাতা চালু হবে অন্যদিকে উৎসবের আয়োজনকে শৃঙ্খলিত করা হবে-এটা স্পষ্টতই স্ববিরোধিতা। উৎসব করার সব ব্যবস্থা থাকবে, আবার নিয়ন্ত্রণও থাকবে-এটা কেমন কথা? এটা কী তবে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমত সাঁতার কাটার মতো অবস্থা নয়? অবশ্য আমাদের সব কিছুই এমন স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ওলামা লীগ তো বর্ষবরণকে নাজায়েজ ঘোষণা করে এই অনুষ্ঠান বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। আবার প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী ঘটা করে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে শামিল হবার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন! এ ভাবেই ‘ঝালে-ঝোলে-অম্বলে’ চলছে সব কিছু।
যে উৎসবটাকে আমরা বলছি বাঙালির ‘প্রাণের উৎসব’, কোনো বিশেষ ধর্মের বাইরে সব মানুষের, সব জাতিগোষ্ঠীর উৎসব-সেটাকে ধর্ম আর নিরাপত্তার অজুহাতে ‘কর্তন’ বা ‘খণ্ডিত’ করার একটা অপপ্রয়াস যেমন আমরা দেখছি, পাশাপাশি দেখছি বর্ষবরণের একটা যুক্তিহীন হুজুগ। আপাতত সেই হুজুগের জয় হোক-আমরা সেটাই চাই। তাতে অন্তত ধর্মব্যবসায়ীদের গালে থাপ্পর পড়বে। ছাই পড়বে লম্পটদের বাড়াভাতে, যারা নারীর চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এটাই হবে আমাদের জন্য সুদিন!
আমাদের সুদিনের স্বপ্ন যেন কেবল হারিয়ে যায়। প্রত্যেক নতুন বছরে যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার মিনার গড়ে তুলি, বছর শেষে দেখা যায় তা অনন্ত জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়ে আমাদের উপহাস করছে। নববর্ষ আসে নববর্ষ যায়, কিন্তু আমাদের জীবনে নেমে আসা অনিশ্চয়তার অন্ধকার যায় না। গত বছরের শুঁটকিকেই এ বছরের তাজা মাছ মনে করে আবার আমরা স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন পরের বছর আবার দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেই পুরনো গল্পটি মনে পড়ছে। এক দাগী চোর মৃত্যুশয্যায় ছেলের হাত ধরে বলেছিলো, বাবা তুই এমন কাজ করবি যাতে করে মানুষ আমার অপকর্মের কথা ভুলে যায়। সবাই আমাকে ভালো বলে। ছেলে বড় হয়ে বাবার কলঙ্কের অপবাদ ঘুচিয়েছিলো। তবে উপায়টা ছিলো ভয়াবহ। বাবা চুরি করেই ক্ষান্ত ছিলো; কিন্তু ছেলে শুধু চুরিই করতো না, চুরির পর ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিতো। ছেলের এই ভয়ঙ্কর ভূমিকায় মানুষজন আস্তে আস্তে বাবার অপকর্মের কথা ভুলে গেলো। সবাই তখন বলতে শুরু করলো, এর চাইতে ওর বাপই ভালো লোক ছিলো। আমাদের অভিজ্ঞতাও অনেকটা এরকমই। এক বছরের ভয়াবহতা দেখে বলেছি, এর চাইতে আগেই তো ভালো ছিলাম!
তারপরও আমরা বাংলা নববর্ষে ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব! সবাই মিলে আনন্দে মাতোয়ারা হবো! আমাদের বর্ষবরণের সম্মিলিত হুজুগে সব নিয়ন্ত্রণের শেকল, নিষেধাজ্ঞা, মৌলবাদীদের সব ফতোয়া ভেসে যাক, মুছে যাক!
(এ বিভাগে প্রকাশিত
মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির
সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)