ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্বের অনেক দেশে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে। তবে অচেনা লোকদের দ্বারা পরিচালিত কিছু ফেসবুক গ্রুপের নেটওয়ার্ক পুতিনের সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন করতে চায়। গ্রুপগুলোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে হাস্যোজ্জ্বল, পরোপকারী এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ সেসব পোস্ট দেখেছেন।
এদেরকে পুতিনের ‘সুপারফ্যান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে বিবিসি। সেই সকল সুপারফ্যানদের ট্র্যাক করে তারা কী করে এবং কোথা থেকে এসেছে তা জানবার এবং জানাবার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
অসংখ্য সমর্থক
বিবিসি ‘ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’ (আইএসডি)’র গবেষকদের সহায়তায় পুতিনপন্থী এই সুবিশাল গ্রুপগুলি নিয়ে তদন্ত করছে।
আইএসডি বিশেষজ্ঞরা পুতিনপন্থী ১০টি পাবলিক গ্রুপকে চিহ্নিত করেছেন। ফেসবুক গ্রুপগুলির মধ্যে একটির নাম ‘ভ্লাদিমির পুতিন – লিডার অব দ্য ফ্রি ওয়ার্ল্ড’। গ্রুপগুলিতে ৬ লাখ ৫০ হাজারেও বেশি সদস্য রয়েছে। গ্রুপে শেয়ার করা কনটেন্ট এর মধ্যে দেখা যায় রাশিয়ান নেতার প্রশংসা করে ছবি এবং বার্তা রয়েছে। পোস্টগুলি ইংরেজিসহ রাশিয়ান, ফার্সি, আরবি এবং খমের সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় লেখা।
পোস্টগুলো শুধুমাত্র জনপ্রিয় নয়, সেখানে বেশ সক্রিয়তাও লক্ষ্য করা গেছে। গত মাসে (মার্চ) গবেষকরা ১৬ হাজার ৫০০টি পোস্ট গণনা করে ৩৬ লক্ষের(৩.৬ মিলিয়ন) বেশি ইন্টারঅ্যাকশন বা মিথষ্ক্রিয়া পেয়েছেন।
পশ্চিমের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো পুতিনকে একজন নায়ক হিসাবে প্রচার করা এবং তার প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ই এই গ্রুপগুলির সামগ্রিক লক্ষ্য বলে মনে করছেন গবেষকরা।
ছবিতে প্রায়শই রাশিয়ান নেতাকে আত্মবিশ্বাসের সাথে কুকুরছানাকে নিয়ে হাঁটতে, ক্যামেরার দিকে টানা তাকিয়ে থাকা অবস্থায়, সৈন্যদের স্যালুটরত অবস্থা এবং ভাল্লুক এবং সিংহ সহ বন্য প্রাণীদের যত্ন নেয়া অবস্থায় দেখানো হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এই গ্রুপগুলিতে লাখেরও অধিক নতুন সদস্য যুক্ত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, গ্রুপগুলির নিয়ন্ত্রণকারীর বেশির ভাগ ফ্যানেরই একই নামে আরও কিছু ভূয়া অ্যাকাউন্ট রয়েছে। গবেষকরা নেটওয়ার্কে এমন অন্তত ১০০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছেন।
ডুপ্লিকেট অ্যাকাউন্ট চালানো ফেসবুকের নিয়মের লঙ্ঘন বলছে আইএসডি।
প্রধান গবেষক মোস্তফা আয়াদ এই ধরনের অনুশীলনকে ব্যাপক সমর্থন দেখানোর প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সক্রিয় ব্যবহারকারী
কিছু গ্রুপ অ্যাডমিনে অস্বাভাবিক কার্যকলাপ দেখা যায়। মেরিন নামে একজন সমর্থক যিনি তার অবস্থান সিরিয়া বলছেন, তিনি তিনটি পৃথক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে পুতিনের পক্ষে সমর্থন তৈরি করেন৷ তার তিনটি অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন একই সময়ে আরবীতে পোস্ট করা হয়।
অন্য একজন মডারেটর, ভিক্টোরিয়া। তিনি কম্বোডিয়া থেকে খেমার ভাষায় গ্রুপগুলিতে কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু শেয়ার করেছন। ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তার পোস্টগুলি ৩৪ হাজারেও বেশি প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে এবং ৪ হাজার বারের বেশি শেয়ার করা হয়েছে৷
মেরিন এবং ভিক্টোরিয়া যৌথভাবে একটি খেমার-ভাষা ফেসবুক পেজ চালায়। যেটি কিছু অ্যাকাউন্টের মধ্যে সমন্বয়ের বিস্তৃত প্যাটার্নের অংশ।
পোস্টগুলো বিভিন্ন গ্রুপে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, বুলগেরিয়ায় অবস্থিত আরেকটি অ্যাকাউন্ট কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পুতিনের একই ছবি ব্যবহার করে ১২ বার পোস্ট করেছে।
বিবিসি মন্তব্যের জন্য এই অ্যাকাউন্টের পিছনে থাকা লোকেদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
কিন্তু কেনিয়া থাকা রাজ নামের একজন ব্যক্তি, যিনি কয়েকটি গ্রুপে রয়েছেন এবং ফেসবুকে তার নামের শেষে “পুতিন” শব্দটি যুক্ত করেছেন, তাকে ফোন করা হলে তিনি জবাব দেন।
সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে তিনি রাশিয়ান রাষ্ট্রপতিকে একজন মহান নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি চলমান যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে চান না। তাকে রাশিয়ার প্রতি তার আগ্রহ সম্পর্কে আরও প্রশ্ন ইমেল করা হলে সে কোন উত্তর দেননি।
আর্মেনিয়ায় হাসমিক জানান তিনি একজন সাংবাদিক এবং বর্তমানে ৬টি পুতিনপন্থী গ্রুপ চালাতে সাহায্য করেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কে তাকে এই কাজ করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে? তিনি বিবিসিকে বলেন, লোকেরা ইতিমধ্যেই গ্রুপগুলি চালাচ্ছে এবং তাকে তার প্রচেষ্টার জন্য কোন অর্থ প্রদান করা হয়নি।
রাশিয়ার যোগসূত্র?
অ্যাকাউন্টের পিছনে লোকেদের প্রেরণা খুঁজে বের করা খুব কঠিন বলে জানিয়েছে বিবিসি। রাশিয়ান সরকারের সাথে গ্রুপগুলোর সুস্পষ্ট কোন যোগসূত্র নেই। অন্যান্য সুপরিচিত রাশিয়ান বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার বা প্রপাগান্ডার মত নেটওয়ার্কটি সূক্ষ্ম নয়; কিংবা জড়িত লোকেরা তাদের উদ্দেশ্যকে গোপন করে না।
তবে নেটওয়ার্কটির রাশিয়ার অভ্যন্তরে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ বা পুতিনপন্থী বিভিন্ন উপাদানের সাথে কিছু লিঙ্ক রয়েছে এমন সম্ভাবনা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।
বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ পুতিন এবং তার পশ্চিমা বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আকৃষ্ট হোন।
ফেসবুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলির বিরুদ্ধে নীতি রয়েছে বলে জানায়। তাদের নিজস্ব তদন্তের তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট স্থগিত করেছে বলেও জানায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি৷
মেটা (ফেসবুক)’র একজন মুখপাত্র বলেন, আমরা ইউক্রেনের সঙ্কট সম্পর্কিত ভুল তথ্যের বিস্তার রোধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া অব্যাহত রাখছি।
ভুয়া পুতিন!
গবেষণা চলাকালে বিবিসি আরেকটি আকর্ষণীয় ঘটনা দেখতে পায় । সেটির একটি হলো ভ্লাদিমির পুতিনের ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট!
পুতিন এমন কয়েকজন বিশ্বনেতাদের একজন, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন না এবং তার নামে কোনো অফিসিয়াল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। মজার ব্যাপার হলো, তার কাছে কোন স্মার্টফোনও নেই।
তার মুখপাত্রের মতে, মিঃ পুতিনের কেবলমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ার প্রয়োজন নেই কারণ এটি তাকে এমন কিছু দেয় না, যা তার কাছে ইতিমধ্যে নেই।
কিন্তু কেউ কেউ তার অনলাইনে অনুপস্থিতির অভাব পূরণ করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ইউক্রেন আক্রমণের পরপরই উপরে প্রদর্শিত ভুয়া ফেসবুক পেজে ত্রিশ লক্ষেরও বেশি ফলোয়ার দেখা যায়।
মহামারী চলাকালে যখন পেজটি রাশিয়ার তৈরি কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে কথা বলছিল তখন ৭ লাখ মানুষ এই পেজে যুক্ত হয়েছিল।
অতি সম্প্রতি পেজটি যুদ্ধ সম্পর্কে ক্রেমলিনের দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ক বার্তা পোস্ট করছিল এবং অনেকেই এতে মন্তব্য করেছেন যে, এটিতে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ই তার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।
ইউক্রেন আক্রমণের কিছুক্ষণ পরে পেজে একটি পোস্টে ঘোষণা করা হয়, ‘অপারেশন এর লক্ষ্য ছিল শান্তি রক্ষা… শুধুমাত্র একটি প্রতিবেশী দেশের নিরস্ত্রীকরণই এর লক্ষ্য।’ এই বার্তাটি ২ লাখ বারের বেশি শেয়ার এবং লাইক করা হয়েছে৷
পৃষ্ঠাটিতে পুতিন সম্পর্কিত বার্তাগুলিতে লোকেদের ট্যাগ করা হতো। ডুপ্লিকেট অ্যাকাউন্ট হিসাবে গবেষকরা যাদের চিহ্নিত করেছেন, তাদেরকে সেখানে ট্যাগ করা হতো। পুতিন সুপারফ্যানদের সাথে এটিকে এক ধরনের ‘আলাপচারিতা’ বলছেন গবেষকরা।
এই অ্যাকাউন্টের পিছনে কে আছে, তা বিবিসি জানে বলছে। ট্রান্সপারেন্সি বিভাগের তথ্য অনুসারে, যারা এটি পরিচালনা করছেন তারা রাশিয়া এবং লাটভিয়ায় অবস্থান করছেন।
আটলান্টিক কাউন্সিলের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের অংশ, ডিজিটাল ফরেনসিক রিসার্চ ল্যাব (ডিএফআরল্যাব) এর গবেষক নিকা আলেকসেজেভা বলেন, ফ্যান পেজগুলি আন্তর্জাতিকভাবে ক্রেমলিনের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করার জন্য উর্বর ক্ষেত্র।
তিনি আরও জানান, মূলধারার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি এগুলো সরিয়ে না নিলে তারা রাশিয়ার তথাকথিত ‘ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের’ বিষয়ে বাইরের দেশগুলিতে জনসমর্থন তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে৷
আলজেরিয়া, লিবিয়া, মিশর, ইয়েমেন, মরক্কো, লেবানন এবং তিউনিসিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে আরবিতে পোস্ট করা হয়। এবং এর জন্য ভুয়া পুতিনের একাউন্টধারীকে কীভাবে অর্থ প্রদান করেছিল তা ডিএফআর-ল্যাবের নথিভুক্ত রয়েছে বলে জানানো হয়। পৃষ্ঠাটির এক মিলিয়নেরও বেশি ফলোয়ার ছিল কিন্তু তারপর থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
আরবি ভাষায় পোস্ট করা আরেকটি পুতিনের পেজ একজন ব্যক্তি পরিচালনা করতেন যিনি সিরিয়ার নেতা বাশার আল-আসাদেরও একজন বড় ভক্ত। সম্প্রতি পেজটি অদৃশ্য হওয়ার আগে এটি প্রায় এক মিলিয়ন অনুসরণকারীকে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল।