বাংলাদেশের ইতিহাসে শেয়ার বাজারে সবচেয়ে বড় ধস নেমেছিল ২০১০ সালে। সেসময় ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের মূল্যও অকস্ম্যাত নেমে গেছে। অর্থাৎ দাম কমেছে। তখন থেকেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি নজর রেখেছে। এছাড়া দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। ফলে দেশের অর্থনীতি রয়েছে গতিশীল। পাশাপাশি সরকার ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের নেতিবাচক ইস্যুগুলো দূর করছে।
এসব বিবেচনায় বিদেশিরা বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। যে কারণে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে পুঁজিবাজার বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৫০ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বলা চলে বাজারে বিদেশী বিনিয়োগের ঢল নেমেছে। বাজার বিশ্লেষকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়া ইতিবাচক। এতে দেশী বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ পায়। বাজার বিস্তৃত হয়। কিন্তু স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সাথে লেনদেন করতে হবে। মুনাফা তুলে নিতে হবে সঠিক সময়ে।
শেয়ার বাজারের ইতিহাসে ১৯৯৬ সালের পর সবচেয়ে বড় দরপতন ঘটে ২০১০ সালে। ওই ধস সামলে পুঁজিবাজারকে আবার টেনে তুলতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। এরমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কর মওকুফসহ বেশ কয়েকটি প্রণোদনা দেওয়া হয়।
শেয়ারের দাম অনেক কম থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসতে থাকে। তাদের দেখে আস্থাশীল হয়ে উঠে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও।
ডিএসইর হিসাব মতে, ২০১৫ সালে বিদেশিরা লেনদেন করেছিল সাত হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা বেড়ে তা দাঁড়ায় আট হাজার ৭৭৩ কোটি টাকায়। আর চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৪২৭ কোটি টাকায়; যা বাজারের মোট লেনদেনের প্রায় পাঁচ শতাংশ।
লেনদেন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে বিদেশি প্রকৃত বিনিয়োগও। বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চেয়ে কিনছেন বেশি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশিরা মোট ৯৪৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এর মধ্যে কিনেছেন ৫৬০ কোটি ৫১ লাখ এবং বিক্রি করেন ৩৮৬ কোটি ৫ লাখ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ বিদেশি নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৪২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। শতকরা হিসাবে নিট বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৫০ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্টে নিট বিনিয়োগ ছিল ৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
২০১৬ সালে বিদেশিদের প্রকৃত বিনিয়োগের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৪০ কোটি টাকা এবং চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে প্রকৃত বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।
বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ভাল লক্ষণ মন্তব্য করে আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বর্তমানে দেশের রাজনীতি স্থিতিশীল থাকায় অর্থনীতি গতিশীল। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে, তারা সেগুলো কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগ করছে। সাধারণত যেসব কোম্পানির ভিত্তি ভাল, যারা বেনাস ও নগদ লভ্যাংশ দেয়। সেসব কোম্পানির শেয়ার কিনছে বিদেশিরা। এর ফলে বাজারে তারল্য বাড়ছে, প্রাইস ডিসকভারি হচ্ছে, ভালো শেয়ারগুলোর দাম বাড়ছে।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ২০১৩ সালের শেষের দিকে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর মধ্যে বিনিয়োগ পদ্ধতি এবং বিদ্যমান আইনকে আরও সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এ লক্ষ্যে গঠিত কমিটি মোট তখন ১৪ সুপারিশ করে যেমন: বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যাপারে উৎসাহিত করা, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো থেকে বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার তথ্য দেওয়া, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পেশাগত তথ্য সেবা ও অনলাইনে সঠিক তথ্য প্রদান, বন্ড ও এসএমই মার্কেট পুনর্গঠন, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি ব্যাংকসহ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তির ব্যাপারে উৎসাহিত করা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির বিদেশি পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনা করার অনুমোদন এবং নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বিদেশির জন্য কোটা বরাদ্দ রাখা ইত্যাদি।
কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেও দেশী বিনিয়োগকারীদের সময়মত মুনাফা তুলে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পুঁজিবাজারে বাবল (কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা) হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বের হয়ে যায়।
সুযোগ সন্ধানী হয়ে বিদেশিরা পুঁজিবাজারকে গতিশীল দেশিয় বিনিয়োগকারীরদের বিপদে ফেলবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারো মনে পুঁজিবাদী চিন্তা থাকলে কিছু করার থাকে না। তবে মনে রাখতে হবে এটা অনেকটা ঝুঁকির ব্যবসা।
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত প্রায় আড়াই বছর বাজারের সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধন বেড়েছে।
২০১৫ সালের চার মে ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৩৯৫৯ পয়েন্ট। ওইদিন লেনদেন হয় ৩৩০ কোটি টাকা। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ডিএসইএক্স সূচক পৌঁছায় ৬২৪০ পয়েন্টে।
২০১৫ সালের চার মে ডিএসইর মূলধন ছিল দুই লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বাজার মূলধন চার লাখ কোটি টাকার বেশি।
বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ভয়ের কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যদের সংগঠন ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি আহমেদ রশিদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাজার ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন ও পুনর্গঠন হয়েছে। তাই বিদেশিদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, বাজারও বড় হচ্ছে। তার মানে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ছিল কম। সাধারণ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল বেশি। এরা সাধারণত স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগকারী। তাই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমেছে। বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান কিনবে। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নাই।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়ছে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, গ্লোবাল বিনিয়োগকারীদের কিছু অর্থ উদ্বৃত থাকে সব সময়। যেটা তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা ও শ্রীলনকাসহ অন্যান্য দেশের বাজার অনেক উঁচু অবস্থায় চলে গেছে। আমাদের বাজার এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই তারা বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তবে এটা টাকার অঙ্কে কিছু বেশি দেখা গেলেও শতকরা হারে খুব বেশি নয়।
তবে শুধু পুঁজিবাজারে নয়, অন্যান্য খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনতিবিদ।