পুঁজিবাজারে অনিয়ম করে কেউ পার পাবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। সম্প্রতি এক আলোচনায় তিনি এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
বিএসইসির চেয়ারম্যান আরও বলেন: প্রয়োজনে খারাপ লোকগুলোকে বাজার থেকে বের করে দেয়া হবে। এটা কথায় নয়, কাজ দিয়ে প্রমাণ করব। শেয়ারবাজারকে পুরোপুরি অটোমেশন করব। কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে তা দৃশ্যমান হবে। অটোমেশন হলে সবার কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সহজে পাবেন। শেয়ারবাজার সবার জন্য সহজ হবে। দেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হচ্ছে, অচিরেই শেয়ারবাজার তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নতুন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত গত কয়েকমাসে নানা পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে অসংখ্য ভার্চুয়াল সেমিনারে কথা বলেছেন। এমনকি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ফেসবুক লাইভে এসেও কথা বলেছেন, যা ইতোপূর্বে বিশ্বের অন্য কোনো শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। এটাকে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট সকলেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
শেয়ার বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এরিমধ্যে আর্থিক হিসাব অর্থাৎ আয়-ব্যয় এবং স্থায়ী সম্পদের মিথ্যা বা সন্দেহজনক তথ্য প্রদানের জন্য গত কয়েক মাসে এক ডজনেরও বেশি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করেছে বিএসইসি। অস্বচ্ছ আইপিও আবেদন করে কেউ আর অনুমোদন পাচ্ছে না। ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আবার আশায় বুক বাঁধছেন।
বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম দায়িত্ব নেয়ার পর ডিএসইর প্রধান সূচক যেমন বেড়েছে, তেমনি ৬০ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন উঠে এসেছে হাজার কোটি টাকার ওপরে। পুঁজিবাজারে এসেছেন নতুন বিনিয়োগকারী।
শুধু দেশেই নয়, বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতেও উদ্যোগ নিয়েছেন নব নিযুক্ত চেয়ারম্যান। তিনি জানান, ৯ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ে রাইজিং অব বেঙ্গল টাইগার : পটেনশিয়াল অব বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেটস নামে চারদিনব্যাপী রোড শো অনুষ্ঠিত হবে। রোড শোতে অংশগ্রহণ করবে বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, কমিশনার ও নির্বাহী পরিচালক, ডিএসই, সিএসইসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এছাড়াও রোড শোতে অংশগ্রহণ করতে আগামী ২৫ জানুয়ারির মধ্যে নাম নিবন্ধন করার জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে চিঠি দিয়েছে বিএসইসি। এ চারদিনে পাঁচটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। সেমিনারগুলোতে বিএসইসির চেয়ারম্যানসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন।
এ চারদিনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিয়ে ইনভেস্টর সামিট, বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট, দ্যা নিউ ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটি ইন বাংলাদেশ, স্কোপ অব প্রাইভেট ইক্যুইটি অ্যান্ড ভেনচার ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ এবং বাইলেটারেল অ্যান্ড মাল্টিলেটারেল মিটিং অনুষ্ঠিত হবে।
এসব কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে প্রবাসী বিনিয়োগকারী সরাসরি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন এবং নিজের বিনিয়োগ নিজেই পরিচালনা করতে পারবেন বলে মনে করেন বর্তমান চেয়ারম্যান। সেই সাথে বিদেশে অবস্থান করা অনেক সম্পদশালী বাংলাদেশি রয়েছেন, যাদের প্রচুর অলস অর্থ রয়েছে। কিন্তু তারা বিনিয়োগ করার মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের জন্যও বড় সুযোগ আসবে বলে মনে করেন তিনি।
একদিকে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বাড়ানো অন্যদিকে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কাজ সমানতালে চালাচ্ছেন তিনি। বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম মনে করেন পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের আওতায় চলে আসলে পুঁজিবাজার অনেকদূর যাবে।
দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেন। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ও আলোচিত উদ্যোগগুলো হলো:
• টানা দরপতনের কারণে শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয় তৎকালীন কমিশন। যাতে কোনো শেয়ারে একটি দরের পর আর পতন না হয়। এতে বড় পতনের হাত থেকে রক্ষা পায় শেয়ারবাজার ও বিনিয়োগকারী।
• শেয়ারবাজার চালু হলেও লেনদেনের সময় কমিয়ে দেয়া হয়।
• ধীরে ধীরে সময় বাড়লেও লেনদেন থাকে তলানিতে।
• জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়।
• সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়।
• আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
• বাতিল করা হয় বেশ কিছু দুর্বল কোম্পানির আইপিও।
• সম্পূর্ণ শেয়ারবাজারকে আইটি প্লাটফর্মে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
• আইসিবি পুনর্গঠনের জন্য একজন কনসালটেন্ট এবং আইটি প্লাটফর্ম তৈরিতে একজন কনসালটেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়।
• বাজার পরিস্থিতিকে গতিশীল করতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে, বাজারকে আকর্ষণীয় করতে নানান ধরনের উদ্যোগ হাতে নেয়।
• একই সঙ্গে বাজারের দুষ্ট চক্র ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেন।
• যার ফলে বাজারের সূচক ও লেনদেন তলানি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। বাজারে বাড়তে থাকে মূলধন।
• দীর্ঘদিন ধরে পরে থাকা ২% ও ৩০% শেয়ার ধারণের বিষয়টি বাস্তবায়ন ও ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর বোর্ড পুনর্গঠন। জেড ক্যাটাগরির কোম্পানিকে পুনর্গঠনের জন্য কোম্পানির বোর্ডকে আর্থিক প্রতিবেদন ও কর্মপরিকল্পনাসহ কমিশনে তলব।
• কোম্পানির শেয়ার লেনদেন, উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি ও তালিকাভুক্ত হিসেবে কোম্পানির কার্যক্রম নিয়ে নতুন নির্দেশনা জারি করে কমিশন।
• ওটিসি মার্কেটের কোম্পানি নিয়ে নতুন পরিকল্পনা, আইপিও প্রসেসে সময় কমিয়ে নিয়ে আসা ও আবেদনকারী সবাইকে আইপিও শেয়ার বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগ, লেনদেন বাড়াতে বন্ড অনুমোদন ও শেয়ারবাজারে লেনদেনের নির্দেশ এবং মিউচুয়াল ফান্ডের উন্নতিতে কার্যক্রম হাতে নেয় কমিশন।
• কমিশন সকল নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে বৈঠক করেছে এবং তাদেরকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যাতে করে কোম্পানির জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
• শেয়ারবাজারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার বিশেষ ফান্ডের তদারকি ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করা ও নতুন ফান্ডের বিষয়ে কাজ করছে কমিশন।
• শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে অলসভাবে পরে থাকা সরকারের ট্রেজারি বন্ডের লেনদেনের বিষয়েও কাজ করে যাচ্ছে বিএসইসি।• নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাজারে ছুটে এসেছেন লাখের অধিক নতুন বিনিয়োগকারী। সূচক, লেনদেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা সবকিছু মিলে ফুরফুরে অবস্থায় ২০২০ সাল শেষ করতে যাচ্ছে শেয়ারবাজার।
• বহুজাতিক কোম্পানিসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে আইপিওর অনুমোদন দেয়া হয়।
• বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় ১৩টি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করা অন্যতম।
• ফ্রিজ করেছে অনেক কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকদের বিও হিসেবে থাকা শেয়ার।
• বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে অনেকের ব্যাংক হিসাব।
• পরিচালকদের ২ শতাংশ ও সম্মিলিতভাবে ৩০ শেয়ার ধারনের বিষয়ে কমিশনের নির্দেশনা।
• বন্ড মার্কেটকে গতিশীল করতে এনবিআরের সাথে বৈঠক করে কর সুবিধা বাড়ানো
• ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশ সেপ্টেম্বরের আগে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কথা বলা
• আইসিবিকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নেওয়াসহ অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
• পুঁজিবাজারের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের উদ্যোগ। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশের (আইসিবি) জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়। আর আইসিবিসহ স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার, মার্চেন্ট ব্যাংকের জন্য চাওয়া হয় আরও ১০ হাজার কোটি টাকা।
• এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়
• স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কমিশনের সমন্বয়
• অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ
• ব্যাংকের সুদ হার কম থাকায় পুঁজিবাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়ছে। বর্তমানে তারল্য সংকট নেই।
• সুকুক বন্ডের মাধ্যমে বন্ডের বাজারও তৈরি হয়েছে।
• দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা আইপিও আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। যেসব কোম্পানির আইপিও অনুমোদনযোগ্য সেগুলোকে দ্রুত অনুমোদন দেয়া হয়। আর যেগুলোকে অনুমোদন দেয়া সম্ভব নয় সেগুলো বাতিল করে দেয়া হয়।
• বন্ডকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
• দুর্বল ভিত্তির জেড ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর আর্থিক ও ব্যবসায়িক অবস্থা পর্যালোচনা করে কোম্পানিগুলোর অবস্থা উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয় কমিশন।
• ওটিসিতে থাকা কোম্পানিগুলোর বিষয়টিও বর্তমানে পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে।
• মোবাইল ফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড শেয়ার বাজারে আইপিও ছাড়ার অনুমতি পেয়েছে।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধস নামার পর ২০১১ সালে ন্যূনতম শেয়ার ধারণের আইন করে বিএসইসির তৎকালীন কমিশন। ধসের পর ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বে বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়। টানা ৯ বছর দায়িত্ব পালনের পর গত মে মাসে খায়রুল হোসেনের উত্তরসূরি হিসেবে বিএসইসির নেতৃত্বে আসেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। ২০২০ সালের ২০ মে মাসে দায়িত্ব নিয়ে তিনি ন্যূনতম শেয়ার ধারণের আইনের বাস্তবায়নে যেসব সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেন তা ব্যাপক আলোড়ন তোলে। শিবলী রুবাইয়াতের দায়িত্ব গ্রহণের পর ঝিমিয়ে পড়া শেয়ারবাজারে গতি ফিরে আসে। চলমান অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকও।
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ব্যাংকিং এন্ড ইনস্যুরেন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন ১৯৯৩ এর ধারা ৫ ও ৬ এর বিধানাবলী প্রতিপালন করতে শিবলী রুবাইয়াতকে চার বছর মেয়াদের জন্য বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।