আপনি কি সামাজিক মাধ্যমে নিয়মিত? তবে আপনার চোখে নিশ্চয় পড়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর শিবচর উপজেলার হাতির বাগান মাঠে এক পাগলী মেয়ের মা হওয়ার ছবি ও ঘটনাটি। বালির স্তূপের উপর প্রসব করা শিশুটির দিকে কেমন অবুঝ চোখ-মুখ নিয়ে নাড়ীর গিঁট না কাটা সামান্য কাপড় জড়িয়ে ব্যথাতুর তাকিয়ে আছে পাগলী মেয়েটি। ছবিটির দিকে তাকিয়ে শরীর শিউরে ওঠেছে প্রথম যখন দেখেছি। দ্বিতীয়বার যখন দেখেছি তখন প্রচণ্ড কান্না পেয়েছে। তৃতীয়বার যখন দেখেছি ভীষণ লজ্জায় চোখ বুজে এসেছে।
আমার ভাবনায় বার-বার ভেসে এসেছে অনেক আগে দেখা আমাদের বাসার পাশে থাকা এমনই এক পাগলীর কথা। যাকে আমরা প্রতিদিন দেখতাম বাসার পাশে, এলাকা ঘেঁষে ঘোরাফেরা করতে। এর ওর কাছ থেকে চেয়ে খেত। দোকান মোড়েই দেখা যেত বেশি। হঠাৎ করে একদিন থেকে তাকে দেখি না। পাগল কত দিকেই তো যেতে পারে! সে চিন্তা থেকে তার কথা ভাবনায় ছিলনা। অনেক দিন পর আবার হঠাৎ করেই তাকে দেখি সদ্য প্রসূত পুত্রসন্তানসহ এলাকায়! জানা গেল এই বাচ্চাটা তার। আমাদের জানা মতে পাগলীর স্বামী নেই, থাকলেও তার সাথে থাকে না। কোথায় থাকে তাও কারো জানা নেই। অথবা তার কোনদিন স্বামী ছিল কি-না তাও অজানা।
আমরা দেখতাম দারুণ মায়ায় পাগলী তার সে সন্তানটিকে মধুর ছায়ায় আগলে রাখত। অনেক কিছুই সে স্বাভাবিকভাবে বলতে ও করতে পারতো না। কিন্তু তার পুত্রটিকে কীভাবে আদর করতে হবে তা সে ধরতে পারতো। তখন বয়স কম থাকায় আমি প্রায়ই ভাবতাম শিশুটির বাবা কে? পাগলী কি ইচ্ছায় কারো কাছে গিয়েছিল? কে তার কাছে এসেছিল? এমন মানসিক ভারসাম্যহীন একজন অসুস্থ মানুষের উপর কেমন মানুষ হামলে পড়তে পারে? এরপর পাড়ার কোন পুরুষকে আমার বিশ্বাস হতো না। পাগল পাগল কোন পুরুষকে দেখলে আমার মনে হতো, এ কি ওই সন্তানটির পিতা! কোন সাধারণ বেশ-ভূষার তরুণ অথবা মাঝ বয়সী কাউকে অবেলায় ঘুরতে দেখলে মনে হতো, এ কি পাগলীর ঔরসের মালিক!
বয়স্ক অনেককেও মনে হতো এ নয়তো সে পিশাচ! কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি পশুটার। কেউ খোঁজও করেনি। পাগলী হয়তো জানে কিন্তু সে চেনে না। তার কাছে হয়তো সব পুরুষকেই তার সন্তানের পিতা মনে হয়। হয়তো সে জানেই না পিতা মানে কী! সন্তানের মানে কী! হয়তো নাড়ী ছেঁড়ার টানটুকুই সে বোঝে ঈশ্বরের ইচ্ছায়।
এখনও পাগলীকে দেখি এলাকার আশপাশে। তার ছেলেটি বেশ বড় হয়েছে। মাঝে মাঝে দেখি ছেলেটা মায়ের মাথায় তেল দিয়ে বেণী করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখি মা-ছেলে পরম আদরে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। সামনে পড়লে যখন যা পারি হাতে দেই, অনেকটা মায়ায়, অনেকটা লজ্জার দায় থেকে। কেননা, লজ্জার দায় কি আমিও এড়াতে পারি, যখন আমিও একজন পুরুষ?
ছোট বেলার মতো চেনা পাগলীকে নিয়ে আর না ভাবলেও প্রতিদিন দৈনিকে, টিভিতে, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ভেসে আসা এমন পাশবিক কাণ্ড নিয়ে না ভেবে পারা যায় না। এই তো কয়েকদিন আগে আরও একটি ছবি যোগাযোগ মাধ্যমে বিবেককে নাড়িয়ে দিলো করুণ ভাবে- মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণীকে রাতভর ব্যাভিচার করে তার গোপনাঙ্গে রড ও হাত ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলেছে কতিপয় নরপশু। ছবিতে দেখা যায় মেয়েটি ছিন্ন বস্ত্রে জলকাদা গায়ে গ্রাম্য ক্ষেতের আলে পড়ে আছে। পরের দিন তা কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ হয়েছে। জানি না মেয়েটি পরে বেঁচে আছে না মরে গেছে। মরে গেলেও জনবহুল এদেশে কারোই কিছু যায় আসেনি। আসবে যাবেও না। আমাদের মন কেঁদেছে। আমাদের বিবেক নড়েছে। মনে হয়েছে ওই মেয়েটি হতে পারতো আমার বোন, আমার কন্যা, আমার স্বজন।
যদি হতো কী আমি করতে পারতাম! কী আমি করতাম! কার কাছে যেতাম! কে শুনতো আমার কথা! মাদারীপুরের পাগলীটির কথা যেমন কেউ শুনবে না, ক্ষেতের আলে পড়ে থাকা মেয়েটির সত্য কথা যেমন কেউ জানবে না, আমার কথাও হয়তো শোনার মতো কারো সময় হতো না। হয়তো কোন এক করুণার হাত আমার বোনকে, আমার কন্যাকে, আমার স্বজনকে সান্ত্বনা দিতো, অতি মায়া হলে হাসপাতালে পৌঁছে দিতো। ভাগ্যের জোর থাকলে সে বেঁচে থাকতো, না হয় এদেশের আর-দশজন অভাগা কন্যাদের যা হয় তাই হতো। বেঁচে থাকতো পিশাচেরা। যেমন বেঁচে থাকে অথবা যেমন আমরা বাঁচিয়ে রাখি।
এই যে শিবচরের সালমা পাগলী, চাইলে কি তার সন্তানের বীর্যদাতাকে খুঁজে বের করা যাবে না? ওই যে ক্ষেতের আলে পড়ে থাকা মেয়েটি, চাইলে কি তার ব্যাভিচারকারীদের ধরা যাবে না? প্রতিদিন আমাদের কাছে কখনো ভাইরাল হয়ে, কখনো স্বাভাবিকভাবে হাজারো পাষণ্ড কাণ্ডের যে খবর আসে তার বিহিত করা যাবে না? যদি বলি যাবে, তা কি অন্যায় বলা হবে? তা কি অবাস্তব বলা হবে? কে নেয় কার দায়িত্ব! আমরাই গা ছাড়া হয়ে গেছি। আমাদের যারা চালান তারাই তেল ছাড়া গাড়ির মতো লক্করঝক্কর, আর আমরা তার সুযোগ নিয়ে গতিশীল অপকর্মের ওস্তাদ। কে ছোঁবে আমাদের?
পাগলীর পেটে রাতের অন্ধকারে শুধু কি ঠেসে দেয়া বীর্যের উন্মাদনা! সচেতন মানুষও তো পেট থেকে ঝেরে ফেলছি গোপনে কত কত শিশু! ফেলে দিচ্ছি ডাস্টবিনে, রাস্তার পাশে, কুকুরের ঘরে, ঝোপে-জঙ্গলে! কে নেয় কার হিসাব? শুধু শক্তি আর দম্ভের বড়াইয়ে যার যখন ইচ্ছা ছুরি চাকু পিস্তল বসিয়ে দিচ্ছি যার-তার গায়ে গলায়। যার যখন ইচ্ছা গাড়িতে করে উঠিয়ে নিচ্ছি যাকে-তাকে। পথের পাশে, মাঠের কিনারে, নদীতে নালাতে ফেলে রাখছি বস্তাবন্দী লাশ! ইচ্ছা মতো করছি এক বা একাধিক টুকরো, যেন মানুষ নামের চিহ্নটিও পাওয়া না যায় চেনা মানুষের পরিমণ্ডলে। নারী-শিশু-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউ বাদ পড়ছে না আমদেরই পৈশাচিকতা থেকে। আপন মা সামান্য কারণে সন্তানকে শ্বাসরোধ করে ফেলে রাখছে ঘরের মেঝে, বাবা কন্যাকে পিষ্ট করছে ট্রেনের চাকায়, সন্তান মা-বাবাকে বসিয়ে দিচ্ছে ভিক্ষার থালা ধরিয়ে দিয়ে, স্বজন স্বজনের পায়ে কুড়াল মারছে সানন্দে। যেন চারদিকে ইচ্ছার হলি-খেলা, মানুষ নিধনের বিরাট যজ্ঞ বসেছে আপন আপন বুকের উপর। কে থামাবে কাকে? কে দেখবে পিশাচের এমন পৈশাচিকতা?
তারপরও নিরাশ হই না। আশাকে উচ্চ করে বাঁচি সূর্যের সমান সাহস নিয়ে। চন্দ্রগ্রহণে কালো রাতের আলো আরও কালো হলেও ভোরের আশা আছে বলেই হয়তো সালমা পাগলীদের পাশে এসে দাঁড়ায় চার তরুণের মতো মানুষেরা। মানসিক ভারসাম্যহীন সালমার ছোট্ট কন্যাটির আগামী ভেবে শিশুটিকে তুলে দেয় সমাজের সুন্দর কোন এক হাতে। অমানুষের ভিড়েও উঁকি দেয় কিছু মহৎ মানুষ। পিশাচ-মানুষের খোঁড়া গভীর গুহার অন্দরে ভালো মানুষ বাড়বে, রুচিহীন দাঁত লুকিয়ে অমানুষে ঘেরা মানুষেরা হৃদয়ের ফুল প্রস্ফুটিত করবে, রাষ্ট্র তার যত্ন নেবে, আইনের সব হাতের সবগুলো আঙুল মেলে সঠিক ব্যবহার করে প্রতিক্ষেত্রে অন্যায়ের, অবিচারের, ব্যাভিচারের শাস্তি বিধান করবে, পরে নয় আগেই সামাজিক ব্যত্যয়গুলোর দিকে নজর দিয়ে বহমান জটিল বিষয়ে সতর্ক হবে, নিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা দেবে আমদের। এ বিশ্বাসেই বাঁচতে চাই আমরা। অন্যথায় মানবিক মানুষ যদি শূন্যে মিলায়, পিশাচের অরণ্যে কী করে বাঁচবে মানবাত্মা?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)