করোনাকালে বিশ্বব্যাপী যখন মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন হচ্ছিল তখন বাংলাদেশে একজন সাংবাদিককে পিছমোড়া করে বেঁধে আদালতে নেওয়া হয়েছিল। সেই সাংবাদিকের নাম শফিকুল ইসলাম কাজল। ক্ষমতাসীনদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখার কারণে প্রথমে তিনি গুম হয়েছিলেন, পরে নিজ দেশে অনুপ্রবেশ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তিনি এমন আচরণের শিকার হয়েছিলেন।
সাংবাদিক কাজল এখনও কারাগারে রয়েছেন। এ তথ্যটুকু সবাই জানি। এতদিন পর আবার এ বিষয়টি সামনে আনার দরকার কী?
এ প্রসঙ্গ নতুন করে সামনে আনার যৌক্তিক কারণ আছে। করোনাভাইরাস টেস্ট নিয়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রতারণার দায়ে ডা. সাবরিনা নামের একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। বলতে গেলে খুনের অভিযোগ। হ্যাঁ, করোনাভাইরাস এর নমুনা নিয়ে পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেওয়ায় কতজন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন তার কোন হিসাব নেই। সেই খুনিকে যখন গ্রেপ্তার করা হলো, আমরা দেখলাম তার হাতে হাতকড়া নেই!
করোনাভাইরাস মহামারীর শুরু থেকেই চিকিৎসকরা সামনের সারির যোদ্ধা। বহু চিকিৎসক নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে। এটাই চিকিৎসা পেশার মাহাত্য। কিন্তু সেই নীতি নৈতিকতায় পায়ে ঠেলে মানুষ খুনের নেশায় মেতে উঠেছেন এই ডাক্তার সাবরিনা আরিফ। এর মাধ্যমে তিনি চিকিৎসা পেশার হাজার বছরের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছেন। চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের সহজাত প্রবৃত্তিতে কুঠারাঘাত করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো: এমন একজন খুনির হাতেও হাতকড়া দেখা গেল না!
এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, কে ভয়ঙ্কর অপরাধী? একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি, নাকি ডিজিটাল মাধ্যমে লেখালেখি করা একজন সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ? এখন দেখা যাচ্ছে: ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মতপ্রকাশ এখানে ভয়ঙ্কর অপরাধ। বাংলাদেশ সম্পর্কে দিন দিন এমন ধারণাকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া হচ্ছে কেন?
শফিকুল ইসলাম কাজল কী অপরাধ করেছিলেন? এতদিন পর নিশ্চয়ই এমন প্রশ্ন আসতে পারে। কারণ, এক ইস্যু আসলে আমরা আরেক ঘটনা ভুলে যাই। নতুন ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যম মাতামাতি করে থাকে। এর ফলে দিন দিন ইস্যু তৈরি হচ্ছে এখানে। সাংবাদিক কাজল নিজের ফেসবুক আইডিতে একটি খবর প্রকাশ করেছিলেন। এর জেরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য। এই মামলার একদিন পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন শফিকুল ইসলাম। ৫৩ দিন ধরে ‘নিখোঁজ’ ছিলেন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।
বেনাপোলে তাকে পাওয়ার পর অনুপ্রবেশের মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া আগের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ছিল। এসব মামলায় সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন খান আদালতে পাঠান। এ বিষয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে ওসি মামুন খান তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন: ‘হাতকড়া সবাইকে পড়ানো হয়। অন্য আসামীদের যেভাবে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাকেও সেভাবেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আসামীকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে হলে তাকে অবশ্যই হাতকড়া পড়াতে হবে, এটা নিয়ম। আমরা সেই নিয়মটাই পালন করেছি।’
শফিকুল ইসলাম কাজল শুধু নয়, ৫৭ ধারা কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরও অনেকের হাতেই হাতকড়া উঠেছিল। সেসব ঘটনায় নিজেদের পক্ষে সাফাইও গেয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতির শঙ্কায় দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকরা নজিরবিহীনভাবে রাস্তায় পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিলেন। শুরু থেকেই শঙ্কা ছিল এই আইনের মূল টার্গেট হবেন সাংবাদিকরা। সাধারণ মানুষও ভোগান্তির শিকার হবেন। হচ্ছেও তাই। এমন আশঙ্কা থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সম্পাদকরাও পাত্তা পাননি। বিতর্কিত আইন পাস হয়েছে। অথচ বৈশ্বিক মহামারীর এই সময়ে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ডাক্তার নামের কলঙ্ক সাবরিনা যেন বিশেষ আদর-আপ্যায়নে রয়েছেন! এটা কোনভাবেই আইনের শাসনের সঙ্গে মানানসই নয়। তবুও ডাক্তার নামধারী সাবরিনা আরিফকে গ্রেপ্তার করায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ।
একইসাথে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদ এখনও কেন গ্রেপ্তার হচ্ছেন না সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন প্রতারক শাহেদকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। সে বিদেশে যেতে পারেনি বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই আশ্বাসে দেশের মানুষ ভরসা রাখতে চায়। আশা করি, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যতই সংকুচিত হবে দুর্নীতি ততই প্রসার লাভ করবে। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের লেখালেখির ক্ষেত্রে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করতে পারলে গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজরা মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে। এখন তা চিরন্তন সত্য হিসেবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হচ্ছে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্সে আশা জাগায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তুলে নেওয়া বা এর বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দিলে দুর্নীতি আরও কমে জবাবদিহিতা বাড়বে বলেই বিশ্বাস। এজন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারও যে বেকায়দায় নেই তা নয়। সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইনে কেউ কিছু বললেই যারা ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নিয়ে তেড়ে আসেন, তাদের জন্য গত জুনের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রীর একজন বিশেষ সহকারী গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ বা নির্দেশনা দিয়েছেন।
ফেসবুকে তিনি লিখেছেন: ‘কারো কোনো কথা পছন্দ না হলেই ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা, এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হতে হবে। কোনো রাজনীতিবিদের বিপক্ষে কেউ অসম্মানজনক কিছু লিখলে যত না ক্ষতি হয় তার থেকে অনেক অনেক বেশি ক্ষতি হয় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করলে। আর সেই ক্ষতি শুধু মামলা যে করে তার একার হয় না, পুরো রাজনৈতিক সরকারের হয়। আপনার পাড়া মহল্লার বিষয়ে উত্তর সরকারকে জেনেভা গিয়ে জাতিসংঘের সামনে দিতে হয়। একদম মিথ্যা কথা কেউ বললে অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। কিন্তু সমালোচনা, তা যতই অগঠনমূলক হোক না কেন, মামলা পর্যন্ত গড়ানো ঠিক না।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের কারণে সরকারকে যেন আন্তর্জাতিক কাঠগড়ায় দাঁড়াতে না হয়, এজন্য হলেও এই কালাকানুন বাতিল হওয়া দরকার। কিন্তু এর বদলে আমরা কালাকানুন বাতিলের বদলে সাংবাদিকদের টার্গেট হওয়া দেখছি, এমনকি এই আইনে মামলার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত চাকরি হারাচ্ছেন। আর ডা. সাবরিনার মতো অভিযুক্তরা হাতকড়াবিহীন বিশেষ আদর পাচ্ছেন। এই পরিস্থিতির অবসান জরুরি। তবে এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)