আসছে শ্রাবণ মাস। টানা বর্ষণ শুরু হবে। ভাবতেই মনে পড়ে গেল জুন মাসের সেই ভয়াল দিনগুলোর কথা। পাহাড় ধসের ঘটনা মনে উঠলেই আঁতকে ওঠে মন। আমরা সেই দৃশ্য আর দেখতে চাই না। আমরা সচেতন থাকব। আমরা আইন মেনে ঘরবাড়ি তৈরি করব।
টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠত পানি ঢেলে মাটি সরিয়ে লাশ খোঁজা হচ্ছে রাঙামাটিতে।
১২ জুন, মধ্যরাত তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড়ধসে দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়। শুধু রাঙামাটিতেই ১৩০ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ৫৬ জনই রাঙামাটি শহরের।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তিও পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, এবার পাহাড় ধসের যে ঘটনা ঘটেছে, তা স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। কয়েক যুগ ধরে নানামুখী অত্যাচারের ফলে ওই তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ের সামগ্রিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে বলেও তারা মনে করেন।
পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ধরন, পানির প্রবাহ ও আবহাওয়াকে বিবেচনায় না নিয়ে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প ও বসতি হয়েছে। এর ফলাফল হিসেবে বনভূমি ও পানির উৎসগুলো ধ্বংস হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এমন আর না ঘটে, তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ভৌগলিক গঠনের কোনো পরিবর্তন হয়ে গেল কি না, সামনে আরও কোনো বড় বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা আছে কি না, তা দ্রুত সমীক্ষা চালিয়ে বের করতে হবে। সেখানকার মানুষদের বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
পরিবেশবিদরা বলছেন, পার্বত্য জেলাগুলোর মাটির গঠন বিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা। এসব কারণে পাহাড়গুলো শুকনো ও ঝরঝরে হয়ে উঠছে। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে অতিবৃষ্টির চাপ। এতে পাহাড়ের ওপরের অংশের মাটির স্তর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মধ্যে ফাটল দেখা দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো.খায়রুল ইসলাম বলেছেন, পাহাড়ের বনভূমি কমে যাওয়ার সঙ্গে পাহাড় ধসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। গত কয়েক যুগে প্রাকৃতিক বন কেটে গজারি, সেগুন, রাবার ও ফলবাগান তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর শিকড় ছোট ও লতাগুল্ম কম। এতে মাটি আলগা হয়ে গেছে।
অতিবৃষ্টির ফলে মাটি দ্রুত ভেঙে পড়ছে। ফলে পাহাড় ধসের মতো বিপর্যয় ঘটেছে।
বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরামের তথ্যমতে জানা গেছে, পাহাড়ে বনভূমি ধ্বংস, ঝরণা শুকিয়ে যাওয়া এবং অপরিকল্পিতভাবে সড়ক ও বসতি নির্মাণের সঙ্গে পাহাড় ধসের হার ক্রমাগত বেড়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ৪৯০ জন মানুষ পাহাড় ধসে মারা গেছে।
আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হই, তখন সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা অনেক রকম সুপারিশমালা তৈরি করি। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগী হই না। যেমন ২০০৭ সালে সবচেয়ে বড় প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছিল। সেবার পাহাড় ধসে ১২৮ জন মানুষ মারা যায়। তখনকার সরকার পাহাড় ধসের কারণ নির্ণয় ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ তৈরির জন্য একটি আন্ত:সংস্থা কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি পাহাড় ধস প্রতিরোধে করণীয় হিসেবে ৩৬ টি সুপারিশ করেছিল।
এর প্রথম সুপারিশটিই ছিল ভূতাত্ত্বিক জরিপের মাধ্যমে পাহাড়ের মাটির ধারণক্ষমতা এবং পাহাড়ের ঢালের কোণ ও শক্তি নির্ণয় করে তার ভিত্তিতে পাহাড় ব্যবস্থাপনা করা।
২০০৭ সালের পর ১০ বছর চলে গেছে। দেশের অনেক পাহাড়ে রাস্তাঘাট, বৈধ-অবৈধ অনেক বসতি গড়ে উঠেছে। বহুতল ভবন নির্মাণসহ আরও অনেক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই ভূতাত্ত্বিক জরিপের সেই সুপারিশ মানা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ের কোনো অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূতাত্ত্বিক জরিপ করা অপরিহার্য।
ওই সুপারিশের মধ্যে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল-পাহাড়ের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া নিষিদ্ধ করা। পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে নতুন কোনো আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন নিষিদ্ধ করা। কিন্তু পাহাড়ের ওপর ও উপত্যকায় ইটভাটা এবং আবাসন প্রকল্পের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
সুপারিশমালার মধ্যে আরও ছিল পাহাড় কেটে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশ কেটে কোনো স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা কোনো একক সংস্থা, বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের হাতে না রাখা।
বিভিন্ন সমিতির নামে পাহাড় ইজারা নিয়ে অথবা দখল করে যারা পাহাড় ধ্বংস করছে, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করে সেখানে অংশীদারত্বমূলক বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা। পাহাড় কাটা ও পাহাড় ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংস্থার দুর্বৃত্তায়ন কঠোর হাতে আইনানুগ পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা।
এ ব্যাপারে অবশ্য আমাদের মাননীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, পাহাড় ধসের প্রধান কারণ পাহাড় কাটা ও পাহাড় ধ্বংস করা, তা রোধ করার জন্য বিভিন্ন সুপারিশ ছাড়াও সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। আইনে এ ধরণের কাজের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু সরকারেরই অনেক বিভাগ ও সংস্থা আছে, যারা এই শাস্তিযোগ্য কাজগুলো করে। এ জন্য কখনো তারা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।
এই যদি হয় অবস্থা, তা হলে কি-ইবা করার আছে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে বছরের পর বছর ধরে আমাদের এ রকম মুত্যুর উপত্যকা দেখতেই হবে। আর সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমতেই থাকবে।
রাঙামটিতে কেন এত মানুষ মারা গেল? প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই আসে। এত মানুষ কোথায় থেকে এল?
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা তার এক কলামে লিখেছেন, সন্তানের ভালো শিক্ষা, ভালো চিকিৎসার জন্য মানুষ জেলা সদরে বসতি গড়ে তোলে। এভাবে রাঙামাটি জেলা শহরে অপরিকল্পিতভাবে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। আর্থিক অসংগতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও যেখানে সস্তায় জমি পাওয়া গেছে, সেখানে মানুষ জমি কিনে বসতি গড়ে তুলেছে। অনেকে ভাড়া বাসা নিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছে। উপজেলা পর্যায়ে যদি ভাল স্কুল ও ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকত, তা হলে এত মানুষ জেলা শহরে গিয়ে ভিড় করত না। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বসতি গড়ে তুলতে বাধ্য না হলে এবারের পাহাড় ধসে রাঙামাটিতে মানুষের এত মৃত্যু হত না।
তিনি আরও লিখেছেন, রাঙামাটি জেলা সদরে সমতল জমির অপ্রতুলতায় অনেক মানুষ খাড়া পাহাড়ে বসতি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। এবারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ হতাহত হওয়ার এটিও বড় একটি কারণ। শক্তিপদ ত্রিপুরা তার লেখায় স্বীকার করেছেন, পাহাড়িরা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করে না। তারা পাহাড়ের অবস্থাভেদে গাছ-বাঁশ দিয়ে মাচাঙ ঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছে। এটিই তাদের গৃহনির্মাণের ঐতিহ্যগত প্রযুক্তি। পাহাড় কেটে বা কুপিয়ে জুমচাষ বা কৃষিকাজ করে না। এটাই ছিল পাহাড়িদের ঐতিহ্য। কিন্তু এখন অবস্থা বদলে গেছে। অপাহাড়ি বসতি স্থাপনকারীদের দেখাদেখি এখন পাহাড়িরাও কোদাল দিয়ে পাহাড় কুপিয়ে আদা-হলুদ চাষ করে।
শহরাঞ্চলে পাহাড়িরা ঘরবাড়ি বানানোর ঐতিহ্য রক্ষা করে চলছে না। এখন তারাও পাহাড় কাটছে। ফলে তারাও পাহাড়ধসে হতাহত হচ্ছে, তাদেরও ঘরবাড়ি নষ্ট হচ্ছে। নিজেদের জীবন, সম্পদ ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষার জন্য পাহাড়িদের গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া দরকার। একতলা দোতলা ঘর তোলার ক্ষেত্রেও পাহাড় না কেটে প্রকৃতিকে আঘাত না করে ঐতিহ্য অনুসরণ করে ঘরবাড়ি বানাতে হবে।
গাছ-বাঁশ-শন বা টিন দিয়ে একতলা দোতলা ঘর তৈরি করা যায়। পাহাড়িদের গৃহনির্মাণের পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে নতুন প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করা যেতে পারে। যাতে পাহাড় না কেটে গৃহনির্মাণ করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেছেন, এখন পাহাড় ন্যাড়া হয়ে গেছে। পাহাড়ের ঘন বনায়ন নেই। এ জন্য বৃষ্টির পানি সরাসরি পাহাড়ের শিলাস্তরে প্রবেশ করে পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। শুধু ভারী বৃষ্টির জন্যই পাহাড়ধস হচ্ছে না। আরও অনেক কারণ রয়েছে। ভূমিকম্প, পাহাড় কাটা, বন উজারকরা, প্রতিনিয়ত ভারী যানবাহনের ঝাঁকুনি- এমন বিভিন্ন কারণে পাহাড়ধস হতে পারে। এবার পাহাড়ধসে বেশি মানুষ মৃত্যুর জন্য এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে।
বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ভবিষ্যতে হয়তো মৃত্যু কমে যাবে। কিন্তু পাহাড় ধসের প্রকৃত কারণ যদি চিহ্নিত করতে না পারি তা হলে এ ধরনের মৃত্যু হতেই থাকবে। নৃবিজ্ঞানী প্রশান্ত ত্রিপুরা বলেছেন, প্রশাসনসহ কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন বড় রকমের রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কোনো কোনো পত্রিকায় কতজন বাঙালি ও কতজন পাহাড়ি মারা গেল, সেটা উল্লেখ করে খবর প্রকাশ করেছে।
এখানে পাহাড়ি-বাঙালি কারা মারা গেল, সেটা কোনো বিষয়ই না। শেষ পর্যন্ত মানুষ মরেছে এটাই প্রধান। আমরাও তাই মনে করি। মানুষই তো মারা গেছে দেড় শতাধিক। যার গেছে সেই শুধু বোঝে।
আমেরিকার ২৩তম প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন হ্যারিসনকে মানুষ মনে রেখেছে একটা কারণে। তিনি আমেরিকার সব বন সংরক্ষনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কেউ বনের কোনো গাছ কাটতে পারেনি। এর সুফল এখন আমেরিকা ভোগ করছে। আমাদেরও এমন একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেন বনের কোনো গাছ কাটা না হয়, পাহাড়ের কোনো গাছ কাটা না হয়। ইজারা দেওয়া না হয় কোনো বন।
পাহাড় যেন কোনো অবস্থায় আমাদের ভোগের সামগ্রী না হয়। পাহাড়ের গাছ কেটে সেই গাছের কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র বানানো থেকে বিরত থাকব। প্রভাব খাটিয়ে পাহাড় দখলে নিয়ে ঘরবাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন থেকে বিরত থাকব। বিরত রাখব অন্যদের। এই যদি হয় প্রত্যয় বা শপথ তা হলে আর পাহাড়ধস হবে না হয়ত। বা কমে আসবে পাহাড় ধস।
আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হব। প্রিয়জন নিয়ে ঘুরে বেড়াব পাহাড়ে। পর্যটকেরা আমাদের দেশে এসে পাহাড় দেখে মুগ্ধ হবে। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। আর কোন পাহাড় যেন মৃত্যু উপত্যকা না হয়, এ আশা হোক আমাদের সবার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)