তখনও মেট্রো রেল নির্মাণের জন্য রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার প্রধান রাস্তায় কোনো কাঁটাছেড়া হয়নি। সুনসান রাস্তা। দুই পাশ দিয়ে টুক টাক গাড়ি যাচ্ছে! তার মধ্যিখানে পরীর মতো শুভ্র পোশাকে দেখা গেল কিছু তরুণীকে। তারা প্রত্যেকেই ব্যস্ত মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে! কারো হাতে গিটার, কারো গলায় ঝুলানো ইউকেলেলে, একজন বসে আছেন চৌকোনো পারকসানের উপর, আরেকজন মনযোগী কিবোর্ড নিয়ে! মাঝখানে দাঁড়িয়ে অন্যজন গাইছেন ‘আমি পাহাড় থেইকা জাইগা উঠা চান্দেরও পরী, অন্ধকারের মেঘলা মনে জোছনা পড়ি’!
ক’দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি মিউজিক ভিডিওর দৃশ্যপট এটি! যারা এই মিউজিক ভিডিওটি দেখেছেন, কিংবা যারা দেখেননি তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, এটি ছিলো বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীদের প্রথম ব্যান্ড ‘এফ মাইনর’-এর পরিবেশনা! এই গানটি প্রকাশের পরেই আলোচনায় আসে পাঁচ তরুণীকে নিয়ে গঠিত গানের এই দলটি। তবে তাদের শুরুটা হয়েছিলো আরো তিন বছর আগে!
সম্প্রতি চ্যানেল আইয়ে এসেছিলেন ‘এফ মাইনর’-এর চার সদস্য। আলাপে আলাপে তাদের পথচলা, একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধকতা কিংবা প্রতিষ্ঠা পাওয়াসহ ভবিষ্যত স্বপ্নের কথা বলেছেন অকপটে।
পাঁচ নারী সদস্যকে নিয়ে গঠিত ‘এফ মাইনর’। তারা হলেন পিংকি চিড়ান, নাদিয়া রিছিল, গ্লোরিয়া মান্দা, লুসি চিছাম দিবা ও একিউ মারমা। বেশির ভাগ সদস্যই গারো সম্প্রদায়ের। এরমধ্যে চারজনের বাড়িই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায়। কথার শুরুতে দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ভোকাল পিংকি চিড়ান জানালেন, এফ মাইনর পুরোপুরি নারীদের ব্যান্ড হলেও এটির যাত্রা কিন্তু যাদু রিছিল দা’র হাত ধরে!
২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে ‘এফ মাইনর’। কবি যাদু রিছিল ও তার সহকারি অন্তর স্ক্রুসহ শুরুতে এই দলে প্রথমে ছিলেন তিনজন মেয়ে। পিংকি বললেন, শুরুতে আমি আর নাদিয়া ছিলাম, আরেকজন চাকমা মেয়ে ছিল। তিনজন মিলে আমরা গান শুরু করলাম। শুরুতে নিজেদের গানই গাইতাম। নিজেদের গান মানে আমাদের সংস্কৃতির যে গানগুলো মানুষের মুখে মুখে রয়েছে, সেই স্থায়ী গানগুলো। এরপর ধীরে ধীরে আমরা স্টেজে উঠলাম। শো শুরু করলাম নিজেদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এরপর বেশকিছু বাংলা গানও করেছি।
কিন্তু পুরোপুরি মেয়েদের ব্যান্ডে রূপ নিলো কীভাবে ‘এফ মাইনর’? পিংকি বললেন, প্রথম থেকেই আমাদের প্ল্যান ছিল যে, মেয়েদের নিয়ে একটা ব্যান্ড করব। সে জায়গা থেকেই মূলত যাদু দা আমাদের সহায়তা করেন। আমাদের চিন্তাকে সাপোর্ট করে গেছেন, শিখিয়ে দিয়েছেন সবকিছু। গান থেকে শুরু করে বাদ্যযন্ত্র সবই আমাদের তিনি শিখিয়েছেন। এমনকি স্টেজে উঠে কীভাবে পারফর্ম করতে হয়, এটাও তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। আমরা শুধু ভেতরে ভেতরে আমাদের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি।
স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ ছিলো ব্যান্ডের জন্য পাঁচজন সংগীত পিপাসু মেয়ে খুঁজে বের করা। যদিও এটা খুব কঠিন কাজ ছিলো না। পিংকি বললেন, যেহেতু আমাদের স্বপ্ন ছিলো শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়েই একটা ব্যান্ড করা, তাই টুকটাক কয়েকটা শো’য়ের পর আমরা খুঁজতে শুরু করলাম আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে কারা মিউজিক করতে আগ্রহী, কারা ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে ভালোবাসে, এরকম মেয়েদের। পরবর্তীতে আমরা তিনজনকে খুঁজে পাই।
পূর্ণতা পেল এফ মাইনর। পাঁচ তরুণী স্বদর্পে পা রাখলো সংগীতে! ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা যাদু রিছিলও তখন তাদের বললেন, এবার তোমরা নিজেরাই সামলাও। তোমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ!
হ্যাঁ, তারপর থেকেই যেন আরো দ্রুত বদলে যেতে থাকলো ‘এফ মাইনর’-এর পথচলা। পিংকির ভাষায়, তখন থেকেই আমরা পাঁচজন মেয়ে মিলে এখন পর্যন্ত ‘এফ মাইনর’কে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। একের পর এক স্টেজ শো’র পর টিভি শোতেও অংশ নিলাম। অনেক চ্যানেল আমাদের ডাকতে থাকলো, রেডিওতেও গেলাম, বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল থেকেও আমাদের ডাক আসলো। গানের জন্য অন্যরকম একটা দুনিয়ার সন্ধান যেন আমরা পেয়ে গেলাম!
পাঁচ জনের মধ্যে পিংকি সবচেয়ে বেশি কথা বলেন। কারণ তাকেই সামলাতে হয় পুরো ‘এফ মাইনর’। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বলে নয়, পাঁচ জনের মধ্যে বয়সেও তিনি সবার বড়। যদিও সবেমাত্র স্নাতক শেষ করেছেন তিনি। কবে কোথায় স্টেজ শো, টেলিভিশন কিংবা রেডিওতে কবে গাইতে হবে তার সিডিউল সামলানো কিংবা গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার বিষয়টিও তাকেই সামাল দিতে হয়।
পিংকি বললেন, শুরুতে অনেকেই প্রশ্ন করতেন, এখনো করেন যে, ব্যান্ডের সবাই মেয়ে কেন! কীভাবে সামলাবে! তখন তাদের বলি, অনেক ব্যান্ডেই তো দেখি মেয়েরা গাইছেন, গিটার বাজাচ্ছেন, কেউ বা কিবোর্ড বা ড্রাম! তাহলে মেয়েরা মিলে নিজেরাই কেন একটা ব্যান্ড করতে পারবে না! তখন সবাই আমাদের অনুপ্রেরণা দেন। আসলে পাঁচটা মেয়ে মিলে এখন যখন একসঙ্গে রাস্তায় নামি, তখন অন্যরকম একটা সাহস কাজ করে।
ব্যান্ডের বয়স প্রায় তিন বছর। এই সময়ের মধ্যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন কি হতে হয়েছে ‘এফ মাইনর’-কে? এমন প্রশ্ন ছিলো সবার কাছে। গিটারিস্ট নাদিয়া রিছিল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তবে কিছুটা ভেবে পিংকি বললেন ‘এফ মাইনর’-এর এই বিষয়ক অভিজ্ঞতা।
পিংকি বলেন, আমাদের যে সামাজিক ব্যবস্থা, যে পরিপার্শ্ব সেটা তো গানের যে কোনো মানুষের জন্যই অনুকূল নয়, তার উপর আবার নারীদের নিয়ে ব্যান্ড! কথাতো একটু হবেই! কিন্তু এইসব প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো যখন আমরা ব্যান্ড শুরু করি মাথায়ই ছিলনা! এটা অনেক পরে এসে বুঝতে পেরেছি। অনেকেই দেখি আমাদের পেছনে অনেক কিছু বলেন, ‘মেয়েদের ব্যান্ড’! নাক কুঁচকানো, চোখ রাঙানো, মেয়েদের ব্যান্ড দিয়ে কী হবে!-এমন সব কথা শুনেছি। কতো লোকের প্রশ্ন ছিলো, ‘মিউজিক করে কী করবা? শেষ পর্যন্ত তো চাকরি করেই খেতে হবে!’ কিন্তু অনেকেই আমাদেরকে সাহস যুগিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন যে, অন্যের কথায় কান দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরা যেভাবে শুরু করেছো সেভাবেই ব্যান্ডটি চালিয়ে নিয়ে যাও। আমার মনে হয় নেগেটিভিটির চেয়ে পজিটিভ বিষয়গুলি আমরা বেশি দেখেছি আমাদের গত তিন বছরের ক্যারিয়ারে!
‘খুব ভালো রেসপন্স পেয়েছি সকলের। আমরা নেগেটিভ কথাগুলি না নিয়ে অন্যের নাক উঁচা কথাগুলো না নিয়ে, পজিটিভ কথাগুলো নিয়ে পথ চলতে চাই। আমাদেরকে মেয়ে ব্যান্ড হিসাবেই সবাই ডাকে, মেয়ে ব্যান্ড হিসেবে কথা বলে, আমরাও চাই মেয়েদের ব্যান্ড হিসেবে আমাদেরকে সবাই ডাকুক। মেয়েদের ব্যান্ড হিসেবেই সবাই আমাদের চিনুক, জানুক। মেয়েদের ব্যান্ড হিসেবেই ‘এফ মাইনর’ প্রতিষ্ঠা পাক। আর আমাদের পরিবার এই কাজগুলোকে ভালো চোখে দেখেন, আমাদের সাপোর্ট করেন। বন্ধুবান্ধবরা খুব বেশি সাপোর্ট করেন, সেক্ষেত্রে আমরা সমাজের প্রচলিত বাধাগুলিতে বিচলিত নই।’
‘এফ মাইনর’-নিয়ে কতোদূর যাওয়ার স্বপ্ন এই তরুণীদের? স্বপ্নের কথা তুলতেই সবার চোখ মুখ যেন উছলে উঠলো প্রত্যেকের। উচ্ছ্বাস আর আনন্দের ঝিলিক দেখা গেল তরুণীদের তাকানোতেও!
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে পিংকি বললেন, আমাদের স্বপ্ন আসলে অনেক বড়। আমাদের আশা অনেক বিশাল। এখন ‘এফ মাইনর’ সবার কাছ থেকে যে রকম সহযোগিতা সাহায্য পাচ্ছে, যেরকম ভালোবাসা পাচ্ছে, এতে আমাদের স্বপ্ন এবং আশা আরো বড় হচ্ছে দিনকে দিন। আমরা শুধু আরেকটু উন্নত, আরেকটু বেশি ভালো অবস্থানে আমাদের প্রাণের ‘এফ মাইনর’কে নিয়ে যেতে চাই।
স্বপ্ন দেখি এই সময় আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় যে ব্যান্ড দলগুলো রয়েছে, তাদের সাথে একসঙ্গে একদিন স্টেজ শেয়ার করবো। সবার সমর্থন ও ভালোবাসা থাকলে অবশ্যই সেই যোগ্যতা একদিন অর্জন করতে পারব, আমরা আমাদের স্বপ্নের কাছে পৌঁছাতে পারবো।