সাম্প্রতিক সময়ে দেশে শিশু হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘটনার শিকার শিশুদের পরিবার ও পরিচিতরাই ওইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সেই ধারায় রাজধানীর বনশ্রীতে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকে মা-ই খুন করেছে তার দুই শিশুকে। মানসিক অসুস্থতা আর পারিবারিক অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে এর জন্য দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দুই সন্তান তার ক্যারিয়ারে ভালো কিছু করতে পারবে না এই ভাবনা থেকেই পঞ্চম এবং নার্সারী শ্রেণী পড়ুয়া দুই সন্তান অরনী ও আলভীকে হত্যা করেছে তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন।
মায়ের এমন মানসিকতাকে অসুস্থ হিসেবেই মনে করেন মেরি কুরি স্কুলের প্রিন্সিপাল সাকেবা আলী।
সাকেবা আলী বলেন, এমন মানসিকতা সর্বাত্বকভাবে ক্ষতি করছে সমাজের। এখনকার বাবা মায়ের অনেকের মধ্যেই এই মেন্টালিটি দেখা যায় যে তাদের সন্তানকে তারা পড়িয়ে কিছু শেখানোর বদলে গ্রেড পাওয়ার উপরে বেশি গুরুত্ব দেন। শিশুদের পড়াতে হবে কিন্তু সেটা আনন্দের মধ্যে দিয়ে পড়াতে হবে। ওদের উপর নিশ্চয়ই চাপ সৃষ্টি করা যাবে না।
একটুখানি বড় হওয়ার পর পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ থাকতে পারে কিন্তু এত ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এমন প্রতিযোগিতামূলক মেন্টালিটি অসুস্থতারই শামিল। সেকথাই বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়্যারম্যান ড. জিয়া রহমান।
ড. জিয়া বলেন, মা সাইকোলজিকালি অসুস্থ অবস্থাতে এই কাজ করেছে। আমাদের সমাজে সাধারণত তিন ধরনের পরিবার দেখা যায়। যেখানে একটি পরিবার খুবই রক্ষণশীল হয়, অন্য একটি পরিবার পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়। আর কিছু পরিবারে সন্তান খানিকটা অনুশাসন ও খানিকটা স্বাধীনতা পায়। তৃতীয় ধরনের পরিবারই সবচেয়ে ভালো পরিবার।
একটি সমাজে এমন অনেক মানুষের জন্য মনোবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞানী খুব জরুরী। যেমনটা বিদেশে হচ্ছে কিন্তু আমাদের দেশে মনোবিজ্ঞানীর কাছে যাওয়াটাকেও অনেকে লজ্জার বিষয় মনে করেন।
জিয়া রহমান আরো বলেন, অনেক বাবা-মা আছেন যারা সন্তান যা চান তাই দিয়ে দেন কিন্তু একসময় এই সবকিছু প্রাপ্তিই ওদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে আসে সেটা বোঝেন না।
তবে এই সমস্যা থেকে খুব শীঘ্রই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ।
সাকেবা আলী বলেন, আজকাল এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা অনেকটা ভাইরাসের মতো হয়ে গেছে। আমাদের সন্তানদের উপরই আমরা অন্যায় করছি। অনেক স্কুল আছে যারা একটি নির্দিষ্ট বয়স অব্দি পরীক্ষা নিতে চান না। কিন্তু অভিভাবকের তাতে স্বস্তি নেই। তারা চান শিশুরা পরীক্ষা দিক। নিজেদের প্রমাণ করুক। তখন স্কুলের আর কিছু করার থাকে না। এ প্লাস পেলে শিশুর শুধু রেজাল্টই ভালো হবে মানবিক গুণাবলী আসবে না। এখনকার শিশুরাতো শুধুমাত্র একটি যত্ন হিসেবেই গড়ে উঠছে। অনেক বাবা-মা তাদের মানবিক গুণাবলী প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ দেয় না।
জিয়া রহমান বলেন, আজকালকার সমাজ সন্তান ও বাবা-মায়ের মধ্যে অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এজন্য বাবা-মাকে যেমন নিজেদের সচেতন হতে হবে তেমনই সচেতন হতে হবে শিক্ষকদেরও। এখন অনেক কিছুই অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে। প্রযুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয়, ইন্টারনেট সেবা সবার ঘরে ঘরে। এতকিছুর মধ্যে থেকে যে সন্তান খারাপ কিছু শিখছে না তা আমরা কি করে বলবো।
এই ঘটনার আরো গভীরে তদন্ত হওয়া দরকার বলেই মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ। তবে সব কিছুর আগে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন আঁকতে হবে মনে।