বলা হয়, দুটি যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালই হচ্ছে ‘শান্তি’। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই গ্রহবাসী এখন অবধি কোন টোটাল ওয়ার বা সর্বাত্মক যুদ্ধের মুখে পড়েনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার দুই উন্মাদের কারণে যদি সত্যি সত্যি আবার একটা বড় ধরনের যুদ্ধ লেগে যায় এবং সেখানে বিশ্বের বড় শক্তি গুলোও জড়িয়ে যায়, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এই সময়কালকে বলা হবে ‘শান্তির যুগ’। তবে এই শান্তি স্থাপন বা অব্যাহত রাখা তথা যুদ্ধের মতো মানববিধ্বংসী পরিস্থিতি এড়াতে পারমাণবিক অস্ত্রের যে একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে– সে কথা অনেকের কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে।
সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে শান্তিতে নোবেল নিয়ে একটু বলা যাক। এবার এই সম্মানজনক এবং অনেক সময়ই বিতর্কিত পুরস্কারটি পেয়েছে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ প্রচারাভিযান (আইসিএএন)–যাদের নিয়ে বস্তুত কোন আলোচনাই ছিল না নোবেলের গুঞ্জনে। তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জোট হিসেবে পরিচিতি দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস (আইসিএএন) প্রায় ১০ বছর ধরে শতাধিক দেশে কাজ করছে।
মজার বিষয় হলো, পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ প্রচারাভিযানের জন্য যেদিন আইসিএএন-এর নাম ঘোষণা করলো নোবেল কমিটি, সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম জানায়, ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির করা পারমাণবিক চুক্তি অচিরেই পরিহার করতে পারেন ট্রাম্প। ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে ২০১৫ সালে বিশ্বের ছয় শক্তিধর দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। চুক্তির আওতায় ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি হ্রাস করা, ইউরেনিয়ামের মজুদ কমানো এবং অস্ত্র পরিদর্শকদেরকে দেশে প্রবেশ করতে দিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের অভিযোগ, এ চুক্তির মূলমন্ত্র ইরান লঙ্ঘন করেছে। অথচ এই চুক্তিকে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল এবং এবার শান্তিতে নোবেলজয়ীর গুঞ্জন তালিকায়ও ইরানের পরমাণু চুক্তির মধ্যস্থতাকারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ফেদরিকা মোগেরিনি ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফের নামও শোনা গিয়েছিল। অবশ্য গত ১৫ সেপ্টেম্বর আলজাজিরার এক সংবাদে বলা হয়েছিল, অক্টোবরেই ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি থেকে সরে যেতে পদক্ষেপ নিতে পারেন ট্রাম্প। কিন্তু পরমাণু চুক্তি ভেঙে দিলে ইরান আবার পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে ঝুঁকবে কি না, সে আশঙ্কাও রয়েছে।
এবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়ার অনুষ্ঠানে নোবেল কমিটির নেতা বেরিট রিজ অ্যান্ডারসন বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করি, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক বেশি।’
প্রসঙ্গত, গত জুলাইয়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ ও পর্যায়ক্রমে সেগুলো ধ্বংস করার জন্য প্রণীত জাতিসংঘের একটি চুক্তি ১২২টি দেশ গ্রহণ করে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী ৯টি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরায়েল) এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্ট (এফএএস)-এর বরাত দিয়ে গত ৪ মার্চ দৈনিক বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে এই ৯টি দেশের কাছে ১৪ হাজার ৯০০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েল এখনও তাদের পারমাণবিক কার্যক্রমের বিষয়টি স্বীকার না করলেও উত্তর কোরিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এ ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
বস্তুত আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি ও প্রতিরক্ষায় পারমাণবিক অস্ত্র বরাবরই একটি কন্ট্রোভার্শিয়াল ইস্যু। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পরমাণবিক অস্ত্র থাকলে তা বিশ্বশান্তির জন্য প্রয়োজনীয়; কিন্তু উত্তর কোরিয়া বা ইরানের কাছে থাকলে সেটি বিপজ্জনক এবং তারা পৃথিবীর শত্রু। এই দ্বৈত অবস্থান থেকে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে সরে আসতে হবে এবং শুধু উত্তর কোরিয়া বা ইরান নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ভারতকেও পরমাণু অস্ত্রমুক্ত হতে হবে। আর যদি এটা সম্ভব না হয় তাহলে যাদের সক্ষমতা আছে তারা সবাই পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে। চীন-ভারত-পাকিস্তানের মতো পরমাণু শক্তিধর দেশের পাশে থেকে এবং ভবিষ্যতে পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যে মিয়ানমারের, তার সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিবাদে জড়িয়ে বাংলাদেশকেও ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়, পরমাণু শক্তিধর হতে হবে।
বাংলাদেশের যে ভূকৌশলগত অবস্থান এবং যেহেতু বঙ্গোপসাগরের দিকে অনেক শক্তিধরেরই লোলুপ দৃষ্টি আছে, তাতে ভবিষ্যতে নিজের সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা খাতে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে হবে এর কোনো বিকল্প নেই। বরং শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে।
কেননা যে ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক বিশ্বের কথা আমরা চিন্তা করি বা স্বপ্ন দেখি, তা অনেকেই চায় না। বরং যখন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তার খবরদারি আর শক্তিমত্তা প্রদর্শনে ব্যস্ত থাকে, যখনে সে তার নিজের বাণিজ্য আর অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জালে আটকে যায়, তখন তার প্রতিবেশী অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও শান্তিকামী রাষ্ট্রও নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করে।
প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচার জন্য উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায় এবং হুমকি দেয় নাকি তারা হুমকি দেয় বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়া ধ্বংস করে দেয়ার কথা বলেন এটি অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র তর্ক। ধারণা করা অমুলক নয় যে, যদি উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র না থাকত বা তারা পরমাণু অস্ত্র আছে বলে প্রচার না চালাত, তাহলে বহু আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া দেশটিকে গিলে ফেলত। হয় সেখানে কথিত গণতন্ত্রের দাবিতে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে লিবিয়া বা ইরাক বানাত অথবা সরাসরি আক্রমণ চালাত। কিন্তু এখন যেহেতু তাদের পারমাণবিক অস্ত্র এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম মিসাইলও আছে, যা নাকি যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতেও সক্ষম সে কারণে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হম্বিতম্বি চললেও সেখানে হামলা চালানোর আশঙ্কা খুবই কম। অর্থাৎ খারাপ শোনালেও এটি বাস্তবতা যে, উত্তর কোরিয়ার জনগণ ও রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র।
কোন এক দেশকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করা সমাধান নয়। বরং বিশ্ব শান্তির প্রয়োজন সারা বিশ্বকেই পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করা। কিন্তু সেটি কে করবে? যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া রাজি হবে? যদি না হয় তাহলে উত্তর কোরিয়া কেন রাজি হবে? সব দেশেরই এটা ম্যান্ডেট যে, সে তার নাগরিকদের সুরক্ষা দেবে। সুতরাং আমার প্রতিবেশী আমাকে পারমাণবিক অস্ত্রের ভয় দেখাবে আর আমি চাইনিজ রাইফেল নিয়ে নিজেকে খুব শক্তিশালী ভাবব তার সুযোগ নেই।
তবে ট্র্যাজেডি হলো, একদিকে উন্নত এবং ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো মারণাস্ত্র ও মানববিধ্বংসী অস্ত্রের পেছনে বছরে বিলিয়ন ডলার খরচ করে, অন্যদিকে উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলোর মানুষ দুই বেলা পেট পুরে খাওয়ার জন্য লড়াই করে। কারো যুদ্ধ মারণাস্ত্র নিয়ে, কারও ভাত নিয়ে। অথচ অস্ত্রের পেছনে ব্যয় করা এই অর্থ দিয়ে সারা বিশ্বের অভূক্ত মানুষগুলোকেই খাওয়ানো সম্ভব। কিন্তু সে পথে হাঁটবে না ক্ষমতাধররা। তারা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখা এবং অন্যের উপর খবরদারি বজায় রাখতে নিত্য নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করবে, যেগুলোর টার্গেট আসলে তাদের মতো রক্ত-মাংসে গড়া মানুষেরাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)