একটা শহরে কোনো ‘পাবলিক ট্রান্সপোর্ট’ নেই। এটা ভাবা যায়? হতে পারে? পারে না; কিন্তু তা-ই হচ্ছে, এই মেট্রোপলিটন ঢাকা শহরে এবং এর দায়-দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না।
মহানগর ঢাকাকে উত্তর-দক্ষিণে দু’ভাগ করা হয়েছে। নগরবাসী দু’জন আধুনিক নগরপতিাও পেয়েছে। সেই পিতারা নগরকে সুন্দর করার জন্য গলদঘর্ম হচ্ছেন। মানতে বাধ্য হচ্ছি ‘হাতিরঝিল বহুমুখি প্রকল্প’ ঢাকাকে নতুন সৌন্দর্যে নিয়ে গেছে। কুড়িলসহ আরো ক’টি ফ্লাইওভার ঢাকার গতি একটু বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বলে এমন হবে নগর পরিবহণ ব্যবস্থা?
বিআরটিসি’র নামে শহরে কটি বাস চলে, তবে এগুলো কারা চালায় তা নগরবাসীর জানা নেই। ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে দশা এমন হয়েছিলো যে বিআরটিসি বাসগুলো লিজ দিয়ে দেয় মাফিয়াদের কাছে। এরপর প্রশ্ন হলো কোটি মানুষের মহানগরে ওই কটি বাস কী করতে পারে!
সুযোগ নিচ্ছে পরিবহণ সন্ত্রাসীরা। যে যার মতো রুট খুলে বাস চালাচ্ছে শহরজুড়ে। কোনটার নাম সিটিং সার্ভিস, কোনটার নাম ডাইরেক্ট আবার কোনটার নাম গেটলক সার্ভিস। যে যার মতো ভাড়া নিচ্ছে, যাত্রীদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে, কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
তুরাগ থেকে বুড়িগঙ্গা, ডেমরা থেকে মিরপুর, এই তো ঢাকা শহর; এইতো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতা। এইটুকু সিটিকে সামাল দিতেই ব্যর্থ হচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। নিত্য ছুটে চলা নগরবাসীকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার মতো একটু ব্যবস্থা করতে পারছেন না কেউ।
মুক্তিযুদ্ধ করে পাওয়া একটি দেশের রাজধানীর এমন শ্রী হওয়ার কথা কি ছিলো? বোধ করি না। আর উত্তর যদি না-ই হয়, তাহলে দায়িত্ব কার? ধরা যাক, তুরাগ নদীর দক্ষিণ পারের ‘মডেল টাউন’ উত্তরা থেকে কেউ একজন যাবেন মতিঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মগবাজার, ফার্মগেট, মহাখালী কিংবা গুলশান-বনানী, অথবা কেউ একজন মিরপুর থেকে মতিঝিল, সদরঘাট, তার জন্য, তাদের জন্য পথে কী ব্যবস্থা আছে? কী দায়িত্ব নিয়েছে সরকার? উত্তর-পশ্চিম থেকে একটার পর একটা বাস আছে। সেই বাসের চেহারা-আকৃতি একেক রকম। সেই বাস থামার জন্য একটিও স্ট্যান্ড নেই। বাস চলছে। নিরুপায় মানুষ দৌড়ে উঠছে সেই বাসে। কেউ কেউ টুপ করে পড়ে যাচ্ছে রাজপথে। আর যে নারী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা অফিসে যাবেন বলে বের হয়েছেন ঘর থেকে তার জন্য এই শহর বড় নিষ্ঠুর।
তাহলে এতো কথা কেনো? কেনো এতো বাকবাকুম? জনাব ওবায়দুল কাদের। তিনি আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা। তিনি মন্ত্রী সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের। মাঝে মাঝে তিনি টিভি ক্যামেরা পারসনদের সঙ্গে নিয়ে পথে ঘাটে অ্যাকশনে বের হন। কাকে কাকে যেন চর থাপড়ও বসিয়ে দেন নিয়ম ভাঙার দায়ে। তাকে আন অফিসিয়ালি অনেকে ‘মন্ত্রী ফাটাকেসটো’ বলেও ডাকে। সেই মন্ত্রী একদিন ঢাকা শহরের বাসযাত্রীদের বেদনা বুঝতে নিজেই উঠে পড়লেন ভীড় বাসে। সঙ্গে অবশ্য এবারও ছিলো ক্যামেরা পারসন। তিনি সেদিন কী অভিজ্ঞতা নিয়েছিলেন আমরা তার ডিটেইল জানি না। তবে কয়েকটি অনলাইন পত্রিকা এবং পরের দিন ছাপা পত্রিকায় কিছুটা জেনেছি। কথা হলো মন্ত্রী পথে নামলেন, যাত্রীদের কষ্ট দুর্ভোগ দেখলেন, এনিয়ে প্রতিক্রিয়াও দিলেন, কিন্তু ফল হলো কী?
এখনো হয়নি; এবং সহসা হবে বলেও মনে হয় না। তাহলে উপায়? উপায় নিশ্চয়ই আছে। আমাদের মন্ত্রীরা, এমপিরা এবং মেয়ররাও বিদেশে যান অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য। তারা অনেক অনেক শহর দেখে মুগ্ধ হন, এবং ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে সব কিছু সিকেয় তুলে রাখেন বলে মনে হয়। লন্ডন, নিউ ইয়র্কের মতো ধনি মানুষের শহরেও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছে যারা দেশ চালান বা যারা শহর চালান সেই কর্তৃপক্ষ। যাত্রী পথে থাকুক বা না থাকুক নিয়ম করে বাস, ট্রাম, মেট্রো এসে দাঁড়াবে নির্ধারিত জায়গায়। নাগরিকদের, নগরবাসীকে এ সার্ভিস দিতে বাধ্য সরকার।
জনগণকে সেবা দেয়ার নামে সরকার শপথ নেয়। আমাদের দেশেও সরকার শপথ নেয়, তবে ক্ষমতায় গিয়ে সে শপথ ভুলে যায়। তাই সাধারণ মানুষ পদে পদে বিপদগ্রস্ত হয়। নগরবাসীকে এই নিত্য বিপদ থেকে বের করে আনতে পারে কেবল যারা দেশ চালান, যারা নগর চালান তারা। খুব কঠিন নয়, সরকারের সঙ্গে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সমন্বিত এবং কার্যকর সভা করে পরদিন সকাল থেকেই বদলে দিতে পারেন ঢাকার ট্রান্সপোর্টের চেহারা। কেবল একটু ইচ্ছা আর সিদ্ধান্তের বিষয়।
দুই মেয়র এক হয়ে বললেন, তাদের সিটির ভেতরে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এক ধরনের বাস চলবে। উত্তরা থেকে সদরঘাট, ডেমরা থেকে মিরপুর একটাই বাস, একটাই নাম তার। আর পরিচালনা করবে একটিমাত্র কর্তৃপক্ষ। সেই বাসের সঙ্গে রেল থাকুক, উড়াল রেল আসুক তাতে কোনো সমস্যা নেই, হবে না ছন্দপতনও।
শহরের মানুষ নিয়ম মানে না, এ কথা অন্তত আমি মানতে নারাজ। বছর বিশেক আগে, মতিঝিল থেকে উত্তরা রুটে প্রিমিয়াম বলে একটা এয়ারকন্ডিশন বাস সার্ভিস চালু হয়েছিলো। তখন দেখেছি মানুষ টিকিট কেটে কীভাবে লাইন ধরে বাসে উঠে। আপনারা নিয়ম করে দেখুন, মানুষ মানতে বাধ্য। মানুষ শেষ পর্যন্ত নিয়মেই চলতে চায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)