‘বৈশাখে ইলিশ খাওয়া উচিত না’, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাওয়া উচিত না’ এসব জানিয়ে অনেক ফতোয়া-আওয়াজ-বিতর্ক দেখছি। বৈশাখে কেনো ইলিশ খেতে হবে, তা নিয়েও বিস্তর আলাপ-ব্যাখা। ‘হিন্দুয়ানি-খ্রিষ্টানীয়’ বিভিন্ন নামে পহেলা বৈশাখকে ডাকা হচ্ছে। কীভাবে এই ইলিশ খাওয়া আর শোভাযাত্রার প্রচলন হলো তা না জেনে অনেকে আওয়াজ করছেন। সামাজিক মাধ্যমে হঠাৎ করে এই আওয়াজ বেড়ে গেছে। চাপের মুখে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিভিন্ন তথ্য-ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত মোঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকেই। নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করতো। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মোঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। (সূত্র-ইউকিপিডিয়া)
তবে অনুসন্ধিৎসু বিতর্ক সৃষ্টিকারীরা এই উৎসবের সাথে ধর্মের যোগসূত্র খুঁজে পান ১৯১৭ সালের একটি ঘটনার সূত্র ধরে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে নানা ধর্মের মানুষ অংশ নেন। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি। এখন পহেলা বৈশাখে আরেকটি ধর্মের মানুষ যদি আরেকটি আয়োজন- উৎসব পালন করতে শুরু করেন, তাহলে অনুসন্ধিৎসু বিতর্ক সৃষ্টিকারীরা হয়তো আরেকটি ধর্মকে জড়িয়ে নতুন উৎস খুঁজে পাবেন!
আর মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্ম্পকে যতোটুকু জেনেছি, এর সঙ্গে কোনো ধর্মের কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই।
১৯৮৬ সালে যশোরে এই শোভাযাত্রার সূচনা। চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরের সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল শোভাযাত্রা, যা তখন ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত ছিল। সে বছরই লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় ওই আনন্দ শোভাযাত্রা। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রায় থাকে বিশালকায় চারুকর্ম পাপেট, হাতি ও ঘোড়াসহ বিচিত্র সাজসজ্জা। থাকে বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।
১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম পেতে শুরু করে।
আর গত কয়েকবছর ধরে এই শোভাযাত্রা নিয়ে নানা আলোচনা-বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই আলোচনায় যুক্ত হয়েছে যুক্তি-সূত্রহীন বিভিন্ন ফতোয়া। এই শোভাযাত্রার সঙ্গে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘রথ যাত্রা’ আর ইসলাম ধর্মের শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারীদের ‘তাজিয়া মিছিল’ এর কিছুটা মিল আছে। সেজন্যই হয়তো কেউ কেউ মিল খুঁজতে শুরু করেছেন ধর্মের সাথে।
ঈদ বা পূজা উপলক্ষে আশেপাশে মেলা বসে বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, সেখানে অন্য ধর্মের কেউ অংশ নিলে কীভাবে তার ধর্মের ব্যাঘাত ঘটে তা বুঝতে পারি না এখনো। সরাসরি নামাজে বা পূজায় অন্যধর্মের মানুষ অংশ নিলে হয়তো আলাদা কথা।
আর বৈশাখে পান্তা-ইলিশের প্রচলন নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, দৈনিক জনকণ্ঠের প্রয়াত সাংবাদিক বোরহান আহমেদ ও তার বন্ধুরা ঘটা করে রমনায় এই পান্তা-ইলিশ খাওয়া শুরু করেছিলেন। কবি সিকদার আমিনুল হক, প্রয়াত বোরহান আহমেদ, কবি ফারুক মাহমুদ, কবি হেলাল হাফিজ, সাংবাদিক মাহবুব হাসান, সাংবাদিক শহিদুল হক খান, মুন্সী আবদুল মান্নান, রোজী ফেরদৌস, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালসহ আরো কিছু কবি-সাংবাদিক এই সূচনা আয়োজনে ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। প্রথমে পান্তা আর ডিম ভাজা দিয়ে শুরুর ইচ্ছা থাকলেও ডিমের পরিবর্তে স্থান পায় জাতীয় মাছ ইলিশ।
যেহেতু কবি-সাংবাদিকদের হাত ধরে এই পান্তা-ইলিশের প্রচলন, সেজন্য সবাই নিশ্চিন্তে ‘পান্তা-ইলিশ মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলতেই পারি! তবে এর সঙ্গে কোনো ধর্মের কোনো ধরণের সাংঘর্ষিক কিছু নেই তা জোর গলায় বলা যেতেই পারে। সারাবছরই আমাদের ইলিশের চাহিদা মোটামুটি থাকলেও বৈশাখে তা বেড়ে যায় বলেই হয়তো এই বিতর্ক।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে এই বৈশাখী শোভাযাত্রা-ইলিশ প্যাঁচাল শেষ করতে চাচ্ছি। আর তা হচ্ছে মাদক সেবন আর মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধি। ইলিশের চাহিদা শুধু বৈশাখে বেড়ে গেলেও মাদকের চাহিদা আর ব্যবহার কিন্তু বছরের প্রতিটি দিন-রাত বেড়েই যাচ্ছে। মাদকের সহজলভ্যতা এখন ‘ছেলের হাতের মোয়া’ টাইপ অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে।
যেকোনো ছুতোয় পার্টি-সেলেব্রেশন আর সেখানে মদ-ইয়াবা-ফেন্সিডিলের ছড়াছড়ি। সহজলভ্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে মহল্লার চায়ের দোকান কোথায় পাওয়া যাচ্ছে না মাদক!
আমার নিজ জেলা শহরে একটি মহল্লা আছে, যেখানে ঘরে ঘরে কয়েক যুগ ধরে ফেন্সিডিলসহ অন্যান্য মাদক বিক্রি করে তারা বর্তমানে ইয়াবা যুগে প্রবেশ করেছে। সবাই বিক্রেতাদের চেনে, মাদকসেবী বাচ্চা-বুড়ো তাদের কাছ থেকে কেনে, পুলিশের আশির্বাদ কীভাবে পায় তাও জানে।
একবার আমাদের এমপি সাহেবকেও দেখলাম মাদক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিতে সাক্ষর অভিযান চালাচ্ছেন, সেই ছবি ফেসবুকেও পোষ্ট করেছেন। আমি তার ছবিতে মন্তব্য করেছিলাম, ‘যারা মাদক বিক্রি করে, পুলিশসহ অনেকেই তাদের চেনে… সাপ্লাই বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিন। এইসব সাক্ষর অভিযানে কোনো কাজ হয় না।’
ঢাকা শহরে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় যেতে হয় না মাদক কিনতে। মাদক বিক্রিতে ই-কমার্স বা ফেসবুক পেইজ যদি আমরা সামনে দেখতে পাই, তাহলে আশ্চর্য হবো না। তারা হয়তো অফার করে বসবে ফ্রি হোম ডেলিভারি সুবিধা!
ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে যদি বৈশাখ-ইলিশ বিতর্ক টাইপ আওয়াজ ওই মাদকের বিরুদ্ধে থাকতো, তাহলে হয়তো কিছুটা কাজ হলেও হতে পারতো।
যাইহোক, যতোক্ষণ না ওই আওয়াজ তৈরি হচ্ছে, বিপ্লব-বিতর্ক তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ হয়তো মাদক বিক্রি-সেবন চলতে থাকবে। আর যাদের সামর্থ্য আছে হাজার টাকায় ইলিশ খাওয়ার, তারা ইলিশ খেয়েই যাবেন। যাদের শারীরিক-মানসিক-যৌক্তিক অ্যালার্জি আছে তারা ইলিশ বর্জন করবেন। যারা শোভাযাত্রাকে উৎসবের অংশ মনে করেন তারা যাবেন, যারা নিষেধ মনে করেন তারা যাবেন না। তবে কট্টর ও আইনবিরোধী চাপাচাপি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য না।
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা স্বল্প স্মরণ শক্তির মানুষ। নতুন ইস্যু বা বিতর্কের সূত্র পেলে হয়তো তা নিয়ে ব্যস্ত থাকবো। ভুলে যাবো এই ইলিশ-বৈশাখ বিতর্ক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)