পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল সিনেমা হলের নাম চেয়ে। হাজার হাজার নাম এসেছিল। সেখান থেকে বাবা ঠিক করলেন মধুমিতা নামটি। যে নামের অর্থ মধুর বন্ধু। ৫০ বছর ধরে চলিচ্চত্র শিল্প এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বন্ধু হয়ে আছে মধুমিতা সিনেমা হল। আগামী ১০০ বছর থাকতে চায়।
৫০ বছর পূর্তিতে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রদর্শক সমিতির সভাপতি, সেন্সর বোর্ড সদস্য এবং মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। মধুমিতার শুরু, পথ চলা, প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবাণী চলচ্চিত্র ব্যবসা এবং সিনেমা হল নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি-
প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা পেল একটি সিনেমা হল। কেমন লাগছে?
প্রধানমন্ত্রী আমাকে একবার বলেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ‘ক্লিওপেট্রা’ সিনেমা দেখেছিলেন মধুমিতায়। ৫০ বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এহসানুল করিমকে জানাতে তিনি বলেছিলেন দেখি কি করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর মত ব্যস্ত মানুষ যখন একটি সিনেমা হলকে তার ৫০ বছরে শুভেচ্ছা জানান তখন বোঝা যায় সে প্রধানমন্ত্রী কতটা সংস্কৃতিমনা। তার ‘মধুমিতা’কে রেকগনিশন মানে সিনেমাকে রেকগনিশন। প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবাণী আমাকে আমার পরিবারকে সিনেমার প্রতি আরো দায়বদ্ধ করেছে।
যাত্রা শুরুর গল্প?
একজন মানুষের জেদ, স্বপ্ন, ভালোবাসা আর পরিশ্রমের ফসল আজকের মধুমিতা। বাবা মো. সিরাজউদ্দিন পুরো পাকিস্তানেরই বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ছিলেন খুব বন্ধুবৎসল আমুদে। সম্ভবত ৬৬ সাল হবে। তখন বলাকা ছিল অভিজাতদের অন্যতম বিনোদনের জায়গা। বলাকা সিনেমায় সিনেমা দেখতে যাবেন বলে ১২টি টিকিট চেয়েছিলেন। কিন্তু দুটি পেয়েছিলেন দুটি। কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন সিনেমা হল করবেন। সবার জন্য।
মধুমিতা নামের কারণটা কি?
সাল ১৯৬৭। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে নির্মাণ হবে একটি সিনেমা হল। নাম হবে কী? এটা ঠিক করতে দৈনিক পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন। হাজারো নাম জমা হয়েছিল। বাবার বাছাই ক্ষমতা খুব দূরদর্শী ছিল। অনেক নাম ‘মধুমিতা নামটি পছন্দ করেন সিরাজ। এ নাম প্রস্তাবকারীকে তখনকার দিনে ৫০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। সঙ্গে উদ্বোধনী ছবির টিকিট ফ্রি। ইংরেজি ছবি ‘ক্লিওপেট্রা’ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল হল ‘মধুমিতা’। চলচ্চিত্রের চরম উৎকর্ষ যেমন দেখেছে হলটি তেমনি মুখ থুবড়ে পড়তেও দেখেছে। কেবল ভালোবাসা আর বংশপরম্পরার ঐতিহ্যকে ধারণ করে টিকে আছে সিনেমা হলটি। হলটি উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার বিচারপতি আবদুল জব্বার খান।
শুরুর দিন আপনি ছিলেন?
আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। শুধু খেয়াল আছে খুব আনন্দ হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ১ ডিসেম্বর মধুমিতা সিনেমা হল উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার বিচারপতি আব্দুল জব্বার খান। তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননের বাবা। খেয়াল আছে, দাদী কখনো চাননি বাবা সিরাজউদ্দিন সিনেমা হল করুক। সিনেমা হল যেদিন উদ্বোধন হবে বাবা দাদীকে ঘোরানোর কথা বলে নিয়ে আসেন এখানে তারপর পা ধরে সালাম করে বলেন, তোমার পায়ের ধুলো পেয়েছি। আমার আর কিছু চাইনা। ‘ডাকবাবু’ আর এলিজাবেথ টেইলর অভিনীত ‘ক্লিওপেট্রা’ দিয়ে শুরু হয়েছিল শো। শুরুর দিনই আমরা আধুনিক শব্দ (ম্যাগনেটিক সাউন্ড) সুবিধা নিয়ে চালু করেছিলাম। এখনো আমাদের চেষ্টা থাকে সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে।’
মধুমিতার একটি সিগনেচার এর সুগন্ধি? রহ্স্য কী?
এটাতে অনেক খরচ হয়। শুরু থেকে বাবা আলাদা কিছু করতে চেয়েছেন। মিড-ফোর্ডের সবচেয়ে পুরনো সুগন্ধির দোকান ওটিস থেকে এই সুগন্ধি কেনা হত। যা বিশেষ কায়দায় পুরো প্রেক্ষাগৃহে ছড়িয়ে দেওয়া হত। যার ভালো দিকটা ছিল এর গন্ধটি মনোরম আর খারাপ দিকটি ছিল ছাত্ররা যারা সিনেমা দেখতে আসত তারা বাবা মায়ের কাছে ধরা পড়ে যেত গায়ে সুগন্ধির স্পর্শ থাকায়। পরে ছাত্ররাতো দাবীই তুলেছিল এই সুগন্ধি না ছড়ানো হোক। (হাসি)।
মধুমিতা মুভিজ দেশের অন্যতম বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছিল বলতে হচ্ছে। কারণ শেষ ছবি ৯৩ সালে। সম্ভবত ‘কোবরা’। দুই যুগ ধরে নেই মাঠে? আর কি ফিরবে না তারা প্রযোজনায়? আচ্ছা মধুমিতার প্রযোজনায় প্রথম ছবি কোনটি?
দেখুন আমার বড় ভাই প্রযোজনার বিষয়টি দেখতেন। যখন মারা যান, তার আগে বলেছিলেছিন আমরা আবার নামি। উনার ইচ্ছা ছিল। অন্য দুই ভাই ইন্টারেস্টেড ছিল না। ছোট ভাইটাও ২০১৫ সালে মারা গেল। তবে তারা যদি না আগ্রহ দেখায় তবে আমি নিজে থেকে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করব। ২০১৯ এর মধ্যে কাজ শুরু করব ইনশাল্লাহ। উৎসর্গ’ ছিলো আমাদের প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র। শাবানা, উজ্জ্বল ছিলেন।তখন আমি দেশে ছিলামনা। বিদেশে পড়াশোনা কেরছিলাম। এরপর ‘আঁধারে আলো’, ‘নকল মানুষ’, ‘একমুঠো ভাত’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘নিশান’, ‘আগুন’, অলংকার, আয়না, শীষনাগ, বাগদাদের চোর, কোবরা। ৩০-৩৫টি হবে। যৌথ প্রযোজনায় করলাম ভারতের সঙ্গে প্রথম ‘দূরদেশ’। এখনও মানুষ গায় যেওনা সাথী। এহতেশাম সাহেব অ্যাপ্রোচ করলেন। আর্মি সরকার ছিল। কাগজপত্র যাচাই করে ইনভেস্ট করা হয়েছিল। পুরো ছবিটা কানাডায় হয়েছিল। ‘মিস লংকা’। খুরশীদ আলম আমাকে বলেছিলেন, এ ছবির গানের মাধ্যমে আমার রিবর্ণ হয়েছি। আগুন ছবির গান স্মরণ করুণ। ‘মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারিনা’। রাজ্জাক সাহেব মারা যাবার পর তার ট্রিবিউটে আমরা মধুমিতায় চালিয়েছি। এর কিন্তু কোন টিভি প্রদর্শন হয়নি। বা ইউটিউবে পাবেননা কিন্তু। এবার আমরা যখন চালিয়েছি পেনড্রাইভে না জাজের মেশিনে। অন্তত এখানে পাইরেসি হবেনা।
আপনি বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের অন্যতম সোচ্চার কণ্ঠ?
পাকিস্তান সিনেমা দাঁড়িয়ে গেছে শত্রু ভারতের ছবি চালিয়ে। পাকিস্তান আর তেমন একটা ইমপোর্ট এখন করেনা ভারতের ছবি। কারণ যখন ধ্বংসপ্রায় তাদের ইন্ডাস্ট্রি তখন ভারতীয় ছবি চালিয়েছে। পরে নিজেরা উন্নত হয়েছে। এখন তাদের একাধিক স্টুডিও দাড়িয়েছে। যেখানে হরদম পাকিস্তানের নিজস্ব ছবি তৈরী হচ্ছে। কিন্তু ট্রানজিশন পিরিয়ড কিন্তু ভারতের ছবি দিয়ে পার করেছে তারা। আমার পাকিস্তানী প্রযোজক বন্ধুরা আমাকে বলেছে, তারা ভারতীয় ছবি চালিয়েছে। তাদের নির্মাতারা নিজেদের টেকনিক্যালি উন্নত করেছে। যেটাকে তারা বলছে ‘ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ’। যেখানে তাদের হল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব। ৫-১০টা ছিল সেখানে এখন ১০০ স্ক্রিন পাকিস্তানে।
তার মানে বলছেন, প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করতে হবে?
অবশ্যই প্রতিযোগিতা থাকলে তাড়না থাকে। যাদের সিনেমা আমাদের চাইতে উন্নত তাদেরটা দেখে নিজেরা উন্নত হতে দোষ কোথায়? শত্রুর থেকে নিয়ে পাকিস্তান উন্নত হতে পারলে ভারত তো বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। সেখানে দোষ কোথায়? ৬৫ তে ভারতের ছবি বন্ধ হল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ পাকিস্তানে ভারতের হিন্দী চলে অথচ আমাদের এখানে চলেনা। কেন? একটা ভুল বুঝিয়ে রাখা হচ্ছে চলচ্চিত্রের মানুষদের যে আমরা শেষ হয়ে যাব। যে ধারণাটাই ভুল। বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে ভারতীয় ছবি চলছে তাদের সেন্সরে অথচ সিনেমা হলে যদি আসত তা চলত আমাদের সেন্সরে। যা বাংলাদেশের মূল্যবোধে যায় তাই চলত হলে। অথচ টেলিভিশনে কিন্তু কিছু বাদ পড়ছেনা। আমাদের বাজার তৈরী করতে হবে। মান ভাল বলে গার্মেন্টস কিন্তু আদর পায়। বাংলা চলচ্চিত্রের মান ভালো করতে হবে। সুবাজারজাত করতে হবে। যারা এ কাজে বিশ্বস্ত এবং পরীক্ষিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমি মাহফুজকে বলেছিলাম, জিরো ডিগ্রি দেন চালাই। তিনি উল্টাপাল্টা দাম চাইলেন। একসঙ্গে ছাড়তে হবেতো। নতুবা ভিডিও হয়ে যায়। সবাই দেখে ফেলে।
অর্থাৎ যথাযথ বিপনণ পরিকল্পনা প্রয়োজন?
অবশ্যই। এখন যেমন ঢাকা অ্যাটাক বিদেশে যাচ্ছে। নবাব যাচ্ছে। কিংবা হালদা। সাফল্য দেখ ভালো অগছে। এটা জরুরী। বিদেশ থেকে যখন কেউ ফোন দিয়ে বলে বাংলা ছবি দেখলাম তখন গর্বিত হই। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির কথা আগেও উল্লেক করেছি। তারা যেমন রেভিনিউ আনছে তেমনি ভালো ছবি যদি আমরা এক্সপোর্ট করি তবে সেটিও রেভিনিউ আনবে। তবে তার আগে তো বাজার ক্রিয়েট করতে হবে। আর বাজারে জায়গা পেতে হলেতো প্রতিযোগিতাকে মেনই এগুতে হয়। যোগ্যতা অর্জন করলে কেউ আটকে রাখতে পারেনা।
৫০ বছর পূর্তির আয়োজন কি থাকছে?
খুব বেশি কিছু থাকছেনা। আমরা আসলে আয়োজনটা করব মেজ ভাই ফেব্রুয়ারীতে দেশে আসলে। দারুণ কিছু ঘোষণা থাকবে। শুক্রবার সন্ধ্যায় চলচ্চিত্রের সোনারী সময়ের তারকাদের নিয়ে একটি মিলন মেলা করার ইচ্ছা আছে। আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সি বি জামান, মাসুদ পারভেজ, ওয়াসিম, প্রবীর মিত্র, রাইসুল ইসলাম আসাদ, বাপ্পারাজ, সম্রাট, নায়ক সাত্তার, সুব্রত, এহতেশামের ছেলে মুস্তাক, ইলিয়াস জাভেদ, আনোয়ারা, সুরকার আলম খান, এন্ড্রু কিশোর, প্রযোজক জাহাঙ্গীর খান, হাবিব খান, টেলিসামাদ, ফজলে হক, আওকাত হোসেন, শর্মিলী আহমেদ, শিল্পী চক্রবর্তী, দেবাশীষ বিশ্বাস, তৌকীর আহমেদ, দিঘী, মাস্টার শাকিল, মিয়া আলাউদ্দিন, নাদের চৌধুরী, নূতন উপস্থিত থাকবেন। তবে স্ত্রীর অসুস্থতাজনিত কারণে ফারুক থাকছেন না। অপরদিকে দেশের বাইরে থাকায় ইলিয়াস কাঞ্চন, ববিতা, চম্পা, সুচন্দা থাকছেন না।
সিনেমা হলের পরিবেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে?
রেনোভেশন শুরু করেছি। সময় বদলেছে। এখনকার দর্শক কমফোর্ট খোঁজে। অলরেডি টয়লেট ঠিক করেছি। পরিবেশ এর জন্য ভাইস ভার্সা প্রয়োজন। ভালো ছবি আসুক। ব্যবসা সফল হোক তাহলে পরিবেশ এমনিতে বদলাবে। আমি নিজে পারছি বলে হয়ত পরিবেশ বদলেছি। সবাই তো এটা পারবেনা। আপনি শিল্প ঘোষণা করেছেন ঠিক আছে। কিন্তু মেশিনারীজ এর ট্যাক্স রাখছেন ১৩০%। য মেনে ভালো চেয়ার আনতে গেলেও অনেক বেশি খরচ করতে হয়। যেখানে ভারতে এটি ২% ট্যাক্স। সিনেমা থেকে পয়সা না বের হলে আমি কিভাবে বিনিয়োগ করব। কতদিন ভর্তুকি দিয়ে চালানো যায়।
হল নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা কি?
ইংরেজী ছবি নতুন করে আনতে যাচ্ছি। আমাদের তিন বিঘা জায়গার মাঝে প্রায় ১ বিঘা জায়গা খালি। এখন ১ তলা আছে। চারতলা করে তিনটি সিনেপ্লেক্স করব। থাকবে ফুডকোর্ট। সেখানে শিশুদের খেলার আয়োজনও রাখা হবে। মধুমিতা নিয়ে সামনে অনেক স্বপ্ন আমার। সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করতে চাই।’ আমরা নতুন ভাবে সাজাচ্ছি মধুমিতাকে। ১২০০ আসনের সিনেমা হল এখন প্রয়োজনীয় না। এটাকে ৬০০ সিটের করে ফেলব ২০১৮ এর মধ্যে।
ছবি: ওবায়দুল হক তুহিন