মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে করা মন্তব্যের স্বপক্ষে সাফাই গেয়ে বাংলাদেশের প্রতিবাদ প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে যুদ্ধাপরাধী সাকা-মুজাহিদের ফাঁসির পর পাকিস্তানের অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ মন্তব্য করে ‘অমূলক দাবি’ প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। উল্টো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘মানহানী’র অভিযোগ এনেছে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের নামে গণহত্যা চালানো দেশটি।
উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২২ নভেম্বর প্রথম প্রহরে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃতুদণ্ড কার্যকর করার পর এক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এর আগেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের সাজার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের রাজনীতিকরা প্রতিক্রিয়া জানায়। এসবের প্রতিক্রিয়ায় ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের হাই কমিশনারকে তলব করে এবং কড়া ভাষায় লেখা প্রতিবাদলিপি তুলে দেয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়ার জবাবে পাকিস্তান যা করলো তা রীতিমত ঔদ্ধত্য। এই ঔদ্ধত্যের পর পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রাখাটা হবে পুরো রাষ্ট্রের জন্যই অবমাননাকর। রাষ্ট্রীয়ভাবেই এর অবশ্যই সমুচিত জবাব দেওয়া উচিত।
ভুলে গেলে চলবে না যে, ২৫ বছরের শোষণ-বঞ্চনার পর বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিকে দমন করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তখন প্রতিরোধ যুদ্ধে নামে বাঙালিরা; নয় মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে। একাত্তরে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশেরই কিছু দোসর পেয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে তাতে সমর্থন দেয়; গঠন করে রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী।
মুসলিম লীগ নেতা পাকিস্তান গণপরিষদের সাবেক স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিন একাত্তরে চট্টগ্রামের ত্রাস হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন। সালাউদ্দিন বাংলাদেশের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। অন্যদিকে একাত্তরে আল বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মুজাহিদ। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন তারই নেতৃত্বে হয়েছিল। তিনিও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারেরর মন্ত্রী হয়েছিলেন।
এই দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনায় পাকিস্তান ‘গভীর নাখোশ’ প্রকাশ করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের এই বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে বিবৃতি প্রদানের দুঃসাহস দেখায়।
এর পর দেশটির মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী আসমা জাহাঙ্গীর স্বয়ং বলেন, এই প্রতিক্রিয়া দিয়ে ইসলামাবাদ প্রমাণ করেছে যে, এই দুজন আসলে রাজনৈতিক চর ছিল, কাজ করছিল পাকিস্তানের স্বার্থে। প্রতিবাদলিপিতে ঢাকাও বলেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় দণ্ডিতদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে নিজের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ও সহযোগিতার বিষয়টি স্বীকার করল।
পাকিস্তানে অবস্থানরত আমাদের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকে ডেকে পাঠিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যা বলেছে, তা রীতিমতো ধৃষ্টতা। পাকিস্তানের এই আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর ভাষা নেই। সরকারের উচিত অবিলম্বে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। অনেক আগেই সেটা করা উচিত ছিল।
ইজরাইলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। কেন? কারণ, ইজরাইল ফিলিস্তিনীদের ভূমি কেড়ে নিয়েছে, বাস্তুচ্যুত ও গণহত্যা করেছে। ইজরাইলের চেয়েও ভয়ংকর অন্যায় ও অমানবিক কাজ করার পরও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আমাদের তো এমনটি করা উচিত হয়নি। স্বজাতির রক্তের দায় ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি। খুনী-নিপীড়ক পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কিসের সম্পর্ক?
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে, চার লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করেছে। কোটি কোটি বাঙালি উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিল; ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে অমানুষিক জীবন যাপন করছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল; যার ফলশ্রুতি চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ; যাতে কয়েক লক্ষ বাঙালি মারা যায়। অনেক কষ্ট আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে।
দেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান বাংলাদেশকে নাজেহাল করার কম চেষ্টা করেনি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, পরবর্তী সময়ে জিয়া-সরকারের অধীনে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারকার্য স্থগিত করে দেওয়া ও তাদের পুর্নবাসন করা, বিএনপি’র ৯১-৯৫ সময়ে গোলাম আযমকে বাংলাদেশে পুন:প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা ও সম্প্রসারণ; সবকিছুর সঙ্গে পাকিস্তান ও তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সংশ্লিষ্টতার দৃঢ় অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশ যখন নব্বইয়ের দশকে ইউরোপ-আমেরিকায় বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করছিল, পাকিস্তান সেসময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরে যখন একাত্তরের নরপশুদের বিচারকার্য শুরু হয়, তখন পাকিস্তানীরা বারবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রভাবিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ খালি একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি বিচার প্রক্রিয়ার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখে; তবে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক শীতল হতে পারে’।
গত বছর ১২ ডিসেম্বর, একাত্তরের ঘাতক-দালাল কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। এটি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম ফাঁসি। এর পরপরই কসাই কাদের মোল্লা ও প্রো-পাকিস্তানি বাংলাদেশীদের জন্য পাকিস্তানের কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়।
জামায়াতের পাকিস্তান শাখা কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ আখ্যায়িত করে এবং পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ আক্রমণের আহ্বান জানায়। তেহরিক-ই ইনসাফ দলের প্রধান কসাই নিয়াজীর আত্মীয় সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান বলে, ‘একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা নির্দোষ ছিল’।
বাংলাদেশকে নিয়ে এখনো পাকিস্তান-ফেডারেশানের স্বপ্ন দেখতে থাকা পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান কাদের মোল্লার ফাঁসিতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলে, ‘বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত এক ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের একজন অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাদের মোল্লা। তার মৃত্যুতে প্রতিটি পাকিস্তানি শোকার্ত ও মর্মাহত।’ ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক’ কাদের মোল্লার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ড হওয়ায় (১৬/১২/২০১৩) জামায়াতের (পাকিস্তান শাখা) পার্লামেন্ট সদস্য শের আকবর খান কাদেরের পরিবারের প্রতি সহমর্তিতা জানিয়ে পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক ও নিন্দা প্রস্তাব আনে; যা পাকিস্তান সংসদে পাস হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ যাদের অপরাধের বিচার করে লাখো শহীদের রক্তঋণ শোধের চেষ্টা করেছে সেই সব নরঘাতকদের পক্ষে সাফাই গেয়ে পাকিস্তান ষোল কোটি বাঙালির আবেগকে অপমান করেছে। এমন একটি হন্তারক, অশিষ্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার আদৌ কোনো দরকার আছে কী?
মনে রাখা দরকার যে, পাকিস্থানের সেনাবাহিনী যে কাজ করেছিলো, সেটার দায়ভার রাষ্ট্র পাকিস্থানের উপরই বর্তায়। কিন্তু পাকিস্তান কখনই তাদের সেই অপরাধের কথা স্বীকার করেনি। ক্ষমাও চায়নি। স্বীকার করেনি বাংলাদেশের পাওয়া সম্পদ ফেরত দেওয়ার ইস্যুটির কথা। অথচ শক্তিধর জার্মানী হলোকাস্টের জন্য একাধিকবার ক্ষমা চেয়েছে, অসংখ্য যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছে। ক্ষতিপূরণ গুণেছে বিশাল অঙ্কের। সেখানে পাকিস্তান ক্ষমা চাওয়াতো দূরের কথা, বরং তাদের সেই সময়কার দোসর নিজামী-মুজাহিদ গং-এর বিচারে বাঁধা দেবার চেষ্টা করছে। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারটি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এখনো পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে ঘৃণ্য সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। ওখানে সন্ত্রাসী তৈরি ও বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ জঙ্গী ও তালেবানদের মূল ঘাঁটি হচ্ছে পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ওই দেশটি নানাভাবে আমাদের যতো ক্ষতি করে চলেছে তেমনটি আর কেউ করেছে কিনা সন্দেহ! কাজেই পাকিস্তানের সঙ্গে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে জাতি হিসেবে আমাদের ব্যক্তিত্ব ও মান-সম্মান দুনিয়াব্যাপী কিছু বাড়বে বৈ কমবে না। এতে দেশের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা পাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)