১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নিধনযজ্ঞ। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় লাভের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের দ্বারা নৃশংস হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধর্ষণে নিরীহ বাঙালির জীবন হয়ে ওঠে মানবেতর। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য গণকবর বা বধ্যভূমি যেন সেই পৈশাচিকতারই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
৭১’এর গণহত্যা থেকে রেহাই পায়নি রাজশাহীর মানুষ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী, কর্মকর্তাও। তাদের বর্বরতার সাথে হত্যা করে ফেলে গেছে নরপশুরা। নরপশুদের হত্যাযজ্ঞ এতটাই বৃহৎ পরিসরে ছিল, যার কারণে বাংলাদেশের মধ্যে সবচাইতে বড় বধ্যভূমি বা গণকবর রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে তাদের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করত। দীর্ঘ নয় মাস হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘাঁটি বানিয়ে রাখে পাক হানাদার বাহিনী। আর এই হলের পেছনের জায়গায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ মেরে ফেলে রাখে পাকিস্তানি সেনা ও দেশীয় দোসররা। দীর্ঘ এক মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এই বধ্যভূমি।
যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের আধ মাইল দূরে আবিষ্কৃত হয় একটি গণকবর। সেটা খনন করে মিলেছিল সহস্র মানুষের মাথার খুলি, নরকঙ্কাল। এছাড়াও মিলেছে মানুষের ব্যবহৃত হাতঘড়ি ও কলম, টুপি, এক ও দশ টাকার নোট মিলে তিনশো টাকা, চাবির রিং, সাইকেলের চাবি, কানের দুল, সিগারেটের লাইটার, মানিব্যাগ, কাজলের টিউব, ওড়না, পাথর বসানো আংটি, চিরুনি, মহিলাদের কার্ডিগান ইত্যাদি। পরবর্তীকালে এগুলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়।
পরে শহীদদের স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক কর্মীদের দ্বারা স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও মুক্তিযুদ্ধ বিপরীত শক্তির হাতে সে উদ্যোগ বিপর্যস্ত হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বধ্যভূমিতে ১৯৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়। সে সময় স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ূমের স্ত্রী অধ্যাপক মাস্তুরা খানম এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্ত্রী চম্পা সমাদ্দার। কিন্তু রাতের আঁধারে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা স্মৃতিফলকটি ভেঙে ফেলে।
পরে আবার স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ শুরু করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান। তিনিই ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবারও স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন। এরপর ২০০২ সালে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমদ। ২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শেষ হলে এর উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।
স্মৃতিস্তম্ভটি ৪২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট, প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে এটি বিস্তৃত। স্তম্ভের সামনে রয়েছে মুক্তি মঞ্চ। গোলাকৃতি একটি চৌবাচ্চাকে ভেদ করে চৌকাণাকৃতি ইটের দেয়াল ভেঙে এবরো-থেবরোভাবে গড়া। দেখে মনে হবে গুলির আঘাতে দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। দেয়ালের এমন রূপ দেওয়ার কারণ হলো- ১৯৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর দ্বারা বাঙালিদের নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে হত্যা করেছিল। তাই এখানে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে হত্যার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতার সাক্ষ্য। আর সেই স্মৃতিই ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ।