চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

পর্যটনে ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ ভিত্তিতে শিক্ষিত মজুর!

পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন। পর্যটনকে তারা পেশাদারিত্ব, নান্দনিকতা,  সৌন্দর্য, শিল্প ও জাতীয় আয়ের অন্যতম উৎসে রুপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে। সমুদ্র, নদী, পাহাড়, হাওর ও বনাঞ্চলের দেশ বাংলাদেশ কেন পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে পারছেনা? বিদেশ হতে আগত অনেক পর্যটককে দেখা যায় প্রত্যন্ত এলাকার গেস্ট হাউজে রাত্রি যাপন করতে। অথচ প্রতিটি জেলা, উপজেলায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ডাকবাংলো নির্মাণ করা হয়। এসব ডাক বাংলোয় কমসংখ্যক দেশি-বিদেশী পর্যটকরাই সিট বুকিং করে উঠে থাকে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হল এসব ডাক বাংলো পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

ডাকবাংলো গুলোকে পরিকল্পিতভাবে আবাসিক হোটেল, মোটেলের অনুরুপ নির্মাণ করলে মানুষ স্বল্প টাকায় নিরাপদে আবাসন সুবিধা পেতো। বাংলাদেশের অধিকাংশ মন্ত্রণালয়েরই জেলা কার্যালয়, উপজেলা কার্যালয় এমন কি ইউনিয়ন কার্যালয় রয়েছে।আবার অনেক কার্যালয় কেবলই নামকাওয়াস্তে। এগুলোর কোন কার্যক্রম নেই। সরকারি পতিত জায়গা ও পতিত বিল্ডিং সহ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। যেমন বিএডিস’র কিছু কার্যালয়, ইউনিয়ন পর্যায়ে সমাজসেবা কার্যালয়, উপজেলা পর্যায়ে বন সংরক্ষণ কার্যালয়, টিএন্ডটি কার্যালয় প্রভৃতি।

এছাড়াও রয়েছে জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশলীর কার্যালয়, স্যানিটারী ইনস্পেক্টরের কার্যালয়, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো কার্যালয় প্রভৃতিরও তেমন কোন কার্যক্রম নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বসে বসে বেতন ভাতা নেয়। তাদের উপস্থিতি সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষও জানেনা। এলাকার মানুষের কোন কাজেও লাগেনা তারা। যে এলাকায় যে অফিসের অফিসিয়াল কোন কার্যক্রম নেই সেসব এলাকায় কেন এই নিষ্ক্রিয় অফিস? পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে সারাদেশেই একে ছড়িয়ে দেয়া যায় না কি? প্রতি জেলা, উপজেলাতেই সার্কিট হাউজ ও ডাকবাংলো রয়েছে। এগুলোকে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনলে নিশ্চিত তা লাভজনক খাতে উন্নীত হবে। পর্যটন মন্ত্রনালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী দু’ধরণের। এক হল সরকারি বেতন ভুক্ত আরেক হল, নো ওয়ার্ক নো পে’ভিত্তিতে ডে লেবার। এসব ডে লেবারদের মধ্যে অষ্টম শ্রেনী হতে মাস্টার্স ডিগ্রীধারি শিক্ষিত মানুষ রয়েছে। চাকরি স্থায়ী হবে এই আশায় চাকরির বয়স সীমা পার করে অনেকেই শূন্য হাতে অবসরে যাচ্ছে। পর্যটন মন্ত্রণালয়ে, নো ওয়ার্ক নো পে’ ভিত্তিতে নিয়োগ কৃত প্রায় ৬০০ ডে লেবার রয়েছে। তাদের কার্য-সহকারী বলা হয়। এদের বিভিন্ন পদের মধ্যে রয়েছে: উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী, নিরাপত্তা প্রহরী, সহকারী ইলেক্ট্রিশিয়ান, সহকারী পরিবেশক, ডিস ওয়াশার, এমএলএসএস, ক্লিনার প্রভৃতি।

বেকারত্ব হতে রেহাই পাবার বাসনায় শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এসব পদে নিয়োগ নিয়ে থাকে।আশায় বুক বাঁধে হয়তো তাদের চাকুরি একদিন স্থায়ী হবে। কিন্তু তাদের এই আশা দুরাশাই থেকে যায়। প্রায় ৩৭ টি প্রজেক্টে তারা এসব পদে কাজ করে থাকে।বিভিন্ন হোটেল, মোটেল, বার, রেস্টুরেন্ট তাদের কর্ম এলাকা। তাদের নেই কোন কর্মঘণ্টা, নেই ঈদ বোনাস, বৈশাখী বোনাস, অবসর ভাতা ও চাকুরির স্থায়িত্বকরণের সম্ভাবনা। তারা ৮ ঘন্টা, ১২ ঘন্টা হতে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত ডিউটি পালন করে। তাদের দৈনিক ২৫০ টাকা হতে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা পর্যন্ত মজুরি প্রদান করা হয়। একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে সেদিনটা হয় তাদের বেতনবিহীন।

এনিয়ে এসব শিক্ষিত মজুরদের রয়েছে চাপা ক্ষোভ। স্রেফ অসহায়ত্বের কারণেই তারা এ চাকরিটা ছাড়ছেন না। সূত্রমতে জানা যায়, পর্যটন মন্ত্রনালয়কে রাজস্ব খাত হতে কোন বাজেট দেয়া হয়না। তারা নিজেরা নিজেদের আয়ের উৎস হতে স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা দিয়ে থাকে। তাদের আয়ের উৎসে সরকার ও মন্ত্রণালয়ের কোন নজরদারীও নেই। শিক্ষিত মজুররা পর্যটনমন্ত্রী বরাবর তাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবী জানালে তার নির্দেশনায় পর্যটন কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অপরূপ কুমার চৌধুরি এসব মজুরদের গড়ে ২০০টাকা করে মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে জানা যায়।

সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগেই অপরূপ কুমার চৌধুরী পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ত্যাগ করে অন্য দায়িত্বে চলে গেলে পর্যটন কর্পোরেশনের দায়িত্ব গ্রহন করেন আখতারুজ্জামান কবির।তিনি দায়িত্ব নিয়ে মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে দিচ্ছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রীর নির্দেশনা ও বোর্ডের সিদ্ধান্ত থাকার পরেও তিনি এতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, কারণ মন্ত্রীর পছন্দের বাইরে প্রধান মন্ত্রীর দপ্তরে লবিং করে তিনি পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়াম্যান হয়েছেন। তিনি বলছেন,২০০টাকা করে মজুরি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।কারণ পর্যটনে আয় নেই।

পূর্বের চেয়ারম্যান একবারের জন্যও বাড়তি মজুরি দিয়ে গেল না কেন? আগে এই মন্ত্রনালয়টি ছিল একজন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে।এখন পূর্ণ মন্ত্রীর। আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় এই পূর্ণ মন্ত্রীত্ব বেশির ভাগই দেয়া হয় কম ক্ষমতা সম্পন্ন শরীক দলের নেতাদের।যেমন এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন জি, এম কাদের, রুহুল আমিন হাওলাদার ও বর্তমানে রাশেদ খান মেনন। এজন্য পর্যটন কর্পোরেশনের কর্তা ব্যক্তি এসব মন্ত্রীদের তেমন তোয়াক্কা করেন না।কারণ আমলারা বেশির ভাগই পেশী শক্তি ও ক্ষমতা তোষণে অভ্যস্ত।শরীক দল ছোট দল তাদের প্রধান শরিকের মত এত ক্ষমতা নেই তাই অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নির্দেশ উপেক্ষিত হয়।

আরও একটি বিষয় হল মন্ত্রীর দপ্তর বদলে নতুন নতুন মন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও মন্ত্রীর গোচরে-অগোচরে জড়িয়ে পড়ে পর্যটন কেন্দ্রিক পদ-পদবী ও ব্যবসা বাণিজ্যে। তখন আর তারাও মন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের দিকে নজর রাখেন না।উল্টো পর্যটন কেন্দ্রিক সিন্ডিকেটে জড়িয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে মন্ত্রীর গুরুত্ব হ্রাসের কারণ হয়ে উঠে। মন্ত্রী থাকেন প্রধানমন্ত্রী শাষিত সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতির মত কেবলই শোভা বর্ধণের জন্য। অথচ পর্যটন খাতকে পরিকল্পিত ভাবে একটি সুশৃঙ্খলতায় নিয়ে গেলে এটি অন্যতম আর্থিক খাত হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)