বয়স যখন পাঁচ, তখন খানিকটা দুরন্তপনা কমানোর জন্য ফুটবলের সঙ্গে হামজা চৌধুরীর পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন মা রাফিহা। সেই থেকে ফুটবলকে ভালোবেসে এগিয়ে চলা বর্তমানে লেস্টার সিটির দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডারের। রক্তে মিশে আছে বাংলাদেশি রক্ত। ফুটবলের মতো তাই লাল-সবুজ দেশটি ও এর সংস্কৃতির প্রতি সমান ভালোবাসা আর মমত্ববোধ ধারণ করেন নিজের বুকেও।
বাংলাদেশ-গ্রেনাডিয়ান বংশোদ্ভূত হামজা চৌধুরী এখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল লেস্টার সিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। সঙ্গে ইংল্যান্ডে বসবাস করা সাউথ এশিয়ানদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম। বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাতকারে ২২ বছর বয়সী এ ফুটবলার বলেছেন, জীবনে দুটি বিষয় তার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। এক, ফুটবল। অন্যটি, চুল। চুল কাটাতে ভীষণ অপছন্দ। যে কারণে মাথায় আফ্রিকানদের মতো ‘আফ্রো’ স্টাইলের ঝাঁকড়া চুল।
‘আমার মা খুব জোর করতেন। কিন্তু চুল কাটানোর ব্যাপারে আমার ভীষণ রকম অনীহা ছিল। তাই এই চুলগুলো এভাবেই বেড়েছে।’
ছোটবেলায় ভীষণ ছোটাছুটি করতেন। মা একদিন নিলেন লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই ফুটবলের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে হামজার, ‘মা একদিন আমাকে লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যান। তিনি ভেবেছিলেন এতে আমার শক্তি খানিকটা ক্ষয় হবে।’
‘তিনি আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ও ভিন্ন এক জগত খুলে দিয়েছিলেন। আর তখন থেকেই আমার খেলাধুলার জীবনে প্রবেশ।’
সাত বছর বয়সে মামা ফারুকের সঙ্গে প্রথমবার লেস্টার সিটির খেলা দেখেন হামজা। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিলে ‘দ্য ফক্স’দের জার্সি গায়ে তোলার। ২০১৭ সালে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
হৈচৈয়ে ভরা এক শৈশব পেয়েছেন হামজা। মা ঘরে বজায় রেখেছিলেন বাঙ্গালিয়ানা ঐতিহ্য। মেহমান আসলে ঘরে রান্না হতো ভাত, তরকারী, সমুচা, চা।
স্কুলের ছুটি পেলেই বাংলাদেশে সিলেট জেলায় নানা বাড়িতে বেড়াতে আসতেন হামজারা। সেইসব স্মৃতি আজও অমলিন। পরিষ্কার বাংলা বলতে পারেন। লম্বা ঝাঁকড়া চুলের এক কিশোরের বাংলা বলা দেখে অবাক হতেন অনেকেই।
‘বাংলাদেশে অনেক স্মৃতি। সেখানকার স্মৃতি ভাসলেই আমার মনে আসে যা খুশি করতে পারার স্বাধীনতা। রাত ১০টা পর্যন্ত আমরা হৈচৈ করছি। দুনিয়া সম্পর্কে কোনো হুশ নেই। পূর্ণরকম এক স্বাধীনতা ও সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
‘বাংলা বলতে পারতাম বলে মানুষজন অবাক হতো। আমার চুল একটু ঝাঁকড়া হওয়ায় বাচ্চারা আমার পেছনে লেগে থাকতো। বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই দুই-তিন সপ্তাহের জন্য যেতাম। দারুণ ছিল সময়গুলো। খুব আলাদা।’
‘এটাই আমার সংস্কৃতি। এটাই আমার ঐতিহ্য। এ এক দারুণ কিছু। এই সংস্কৃতি আমাকে ছোট বেলায় নম্র হতে শিখিয়েছে। দেখিয়েছে পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে সম্পূর্ণ এক জগত। কারণ ইংল্যান্ডে বড় হওয়ার সময়টায় আপনাকে একটু বিভ্রান্তিতে থাকতে হয়।’
‘বাংলাদেশে যাওয়ার পর আমি ভিন্ন এক লড়াই দেখতে পেয়েছি। দেখেছি কী সংগ্রামের মধ্যে মানুষজনকে বেঁচে থাকতে হয়। এটাই আমাকে নম্র হতে সাহায্য করেছে।’
ছোটবেলায় ইতিহাস আর অঙ্কে মাথা ভালো ছিল হামজার। তবে তারচেয়েও ভালো ছিলেন ফুটবলে। শিক্ষকরা তার খেলাধুলাকে উৎসাহ দিলেও বিকল্প কিছুরও চিন্তা করে রাখতে বলেছিলেন। এখন হামজার মনে হয় তার শিক্ষকরাই ঠিক।
ইসলাম ধর্মে ভীষণ বিশ্বাসী হামজা। স্কুলের পর মাঠে ফুটবল খেলতে যেতে পছন্দ করলেও ধর্ম শিক্ষাও নিতে হয়েছে তাকে, ‘আমি আমার ছোটবোন প্রতি মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার কোরআন শিখতে যেতাম।’
‘ছোটবেলায় মনে হতো এতে আমার অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। তবে আমি খুশি যে আমার বাবা-মা আমাকে দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তবে ছোটবেলায় আমার মন পড়ে থাকতো খেলার মাঠেই।’
‘ড্রেসিংরুমে প্রবেশের আগে আমি আয়াতুল কুরসি আর কিছু দোয়া পড়ি। মা আমাকে এগুলো পড়তে শিখিয়েছেন।’
লেস্টারশায়ারে বেড়ে ওঠায় জীবনে ফুটবলকে ভালোবাসতে পেরেছেন। তবে এই লেস্টারেই একবার বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন হামজা। মায়ের কারণে সেই ক্ষতটা কাটিয়েও উঠেছেন, ‘আমি এফএর কাছে অভিযোগ করেছিলাম। তবে আমার মা একজন কঠিন মানসিকতার মানুষ। তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে এসবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়।’
হামজা সেই দুই খেলোয়াড়দের একজন যারা সাউথ এশিয়া থেকে উঠে এসে খেলছেন ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ লিগে। আরেকজন হলেন অ্যাস্টন ভিলার নেইল টেলর।
তার এমন উত্থানে বেশ খুশি ব্রিটিশ-এশিয়ান সমাজ। উঠতি বয়সী সাউথ এশিয়ান শিশু-কিশোরদের কাছে হামজা এখন এক অনুপ্রেরণার নাম।
হামজার মা, সৎ বাবা মুরশিদ ও মামা ফারুকের দীর্ঘ এক ত্যাগের ফসল ওঠে ২০১৭ সালে। তৎকালীন লেস্টার কোচ ক্রেইগ শেক্সপিয়ারের অধীনে প্রিমিয়ার লিগ কাপে অভিষেক ঘটে হামজার। এরপর থেকে চোখ জুড়ানো পারফরম্যান্সে লেস্টারের নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠেছেন।
মাঠের বাইরে স্ত্রী অলিভিয়া ও ১৩ মাস বয়সী কন্যা আনিয়াহকে নিয়ে সুখের সংসার হামজার। সময় পেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ান লন্ডন শহর।
যেভাবে ছুটছেন তাতে যেকোনো সময় ডাক পেতে পারেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলে। এমনটা হলে হামজাই হবেন প্রথম সাউথ এশিয়ান বংশোদ্ভূত ফুটবলার যিনি সুযোগ পাবেন জাতীয় দলে।
‘ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলতে পারাটা হল বড় স্বপ্ন। তবে ভাবনা আর বাস্তবে বিশাল ফারাক। আমাকে আরও অনেকটা দূর যেতে হবে। অনেক বেশি বেশি ম্যাচ খেলতে হবে। যাতে আমি জাতীয় দলের যোগ্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারি।’