শিক্ষার উন্নয়নে যুগান্তকারী অবদানের জন্য মর্যাদাসূচক ‘ইদান প্রাইজ ফর এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট লরিয়েট’ হিসেবে ভূষিত হয়েছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তার পরিবারের হাতে মর্যাদাসূচক সেই প্রাইজ তুলে দিয়েছেন এর প্রতিষ্ঠাতা ড. চার্লস চেন ইদান।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদের পরিবারের হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন তিনি।
অর্থমূল্যের দিক থেকে শিক্ষার উন্নয়নে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদাসূচক পুরস্কারের স্বর্ণপদকটি গ্রহণ করেন তার মেয়ে ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড-এর চেয়ারপারসন তামারা আবেদ ও সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন তার ছেলে ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স ও আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন পরিচালক শামেরান আবেদ।
পুরস্কার প্রদান উপলক্ষে এর প্রবর্তক ড. চার্লস চেন ইদান চলতি সপ্তাহে দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন।
শিক্ষার উন্নয়নে যুগান্তকারী অবদানের জন্য ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্যার ফজলে ‘ইদান প্রাইজ ফর এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট লরিয়েট’ হিসেবে ঘোষিত হন। অক্টোবরে ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করেন। এসময় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অঙ্গনের এই কীর্তিমান মানুষটির কাছ থেকে তারা বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে পটপরিবর্তনের লক্ষ্যে তার দিগ়্দর্শী নির্দেশনা এবং কেন্দ্রীয় ভূমিকা বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন।
গত ২০ ডিসেম্বর স্যার ফজলে মৃত্যুবরণ করার পরে ড. চেন ঢাকায় উপস্থিত হয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে ব্র্যাক পরিচালিত একটি স্কুল এবং বনশ্রীতে একটি প্রাক-শৈশব উন্নয়ন কেন্দ্র (আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার) বা প্লে ল্যাব পরিদর্শন করেন।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার উন্নয়নে স্যার ফজলে হাসান আবেদের নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকার কথা স্মরণ করেন ড. চার্লস চেন বলেন, ‘প্রকৃত সহানুভূতি, সাহস ও বিশ্বাসের সঙ্গে মানুষের সেবায় স্যার ফজলে তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। চারপাশের মানুষকে নিরাশা ত্যাগ করে আশাবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনায় আস্থাশীল হতে শিখিয়েছিলেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সারা বিশ্বের জন্য স্যার ফজলে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে বিরাজ করবেন। যে লক্ষ কোটি মানুষের জীবন তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন, বিশেষ করে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর মানুষ তাঁকে আশার স্ফুলিঙ্গ হিসেবে আজীবন মনে রাখবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এশিয়া, আফ্রিকা এবং তারও বাইরে জীবন বদলে দিতে সক্ষম শিক্ষা কার্যক্রম প্রসারে ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশন ব্র্যাকের সঙ্গে ভবিষ্যতেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে। আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা প্রান্তিক শিশুদের আনন্দের সঙ্গে শেখার সুযোগ করে দেবে এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উৎপাদনশীল ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনে ভূমিকা রাখবে।’
অনুষ্ঠানে শামেরান আবেদ ধন্যবাদসূচক বক্তব্য পাঠ করেন যা স্যার ফজলে পুরস্কারটি ঘোষণা হওয়ার পর রচনা করেছিলেন। বক্তব্যে বলা হয়, ‘ব্র্যাক ও আমার কাজের এই স্বীকৃতি আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে। ইদান প্রাইজের সূত্রে প্রাপ্ত বৃহৎ তহবিলটি আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের আরো বিস্তার ঘটাতে বিপুলভাবে সহায়ক হবে। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা হচ্ছে বৈষম্য মোচনের সর্বোত্তম হাতিয়ার। আমি এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখি যেখানে আমাদের মধ্যে দরিদ্রতম মানুষও লক্ষ্যবহ ও মর্যাদার জীবন যাপন করার সুযোগ পাবেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার অভিযাত্রায় সকলকে সামিল হওয়ার জন্য আমি আন্তরিক আহ্বান জানাই।’
তামারা আবেদ বলেন, ‘বাবার পক্ষ থেকে আজ এই পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে আমরা অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। তার বিপুল কর্মযোগের উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
স্যার ফজলে সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষাকে অত্যাবশ্যকীয় অনুঘটক বলে বিশ্বাস করতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন শিক্ষার অর্থ শুধু বিদ্যালয় ও বইখাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সে কারণেই খেলাধুলাভিত্তিক আনন্দের মাধ্যমে শেখা ব্র্যাকের মৌলিক নীতির অন্তর্গত। বাংলাদেশ, উগান্ডা ও তানজানিয়ায় ব্র্যাকের ১,৪০০-এরও বেশি খেলাধুলাভিত্তিক প্রাক-শৈশব উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে যেখানে ১-৫ বছর বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশু ভর্তি রয়েছে। এসব কেন্দ্রে বয়স-উপযোগী খেলার উপকরণ, খেলাভিত্তিক শিখনসূচি ও খেলার পরিসরের মাধ্যমে হাসি-আনন্দ-গানে তাদের সার্বিক বিকাশের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
‘ইদান প্রাইজ ফর এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট লরিয়েট’ হিসেবে স্যার ফজলেকে একটি সোনার মেডেল, একটি সার্টিফিকেট এবং তিন কোটি হংকং ডলার (৩০ মিলিয়ন হংকং ডলার বা ৩.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩৩ কোটি টাকা) মূল্যমানের অর্থ প্রদান করা হয়েছে। অর্থ পুরস্কারের অর্ধেক নগদ অর্থ এবং বাকি অর্ধেক একটি প্রকল্পের তহবিল হিসেবে প্রদান করা হয়েছে।
‘সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলোর শিশুদের চাহিদার প্রতি ব্র্যাক সবসময়ই অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে। ইদান প্রাইজের এই তহবিল বাংলাদেশ, উগান্ডা ও তানজানিয়ায় খেলাভিত্তিক প্রাক-শৈশব উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের উদ্ভাবনগুলোর বিস্তার এবং বাংলাদেশে খেলাভিত্তিক শিশু পরিচর্যার একটি নতুন মডেল উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে,’ বলেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্।
ইদান প্রাইজের অংশ হিসেবে প্রাপ্ত প্রকল্প তহবিলটি (২০ লাখ মার্কিন ডলার বা ১৬.৫ কোটি টাকা) আগামী তিন বছর প্রাক-শৈশব উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা, উদ্ভাবন ও সবচেয়ে কার্যকর সমাধানগুলোর বিস্তারে ব্যয় করবে ব্র্যাক। তহবিলটির একাংশ বাংলাদেশে খেলাভিত্তিক শিশু পরিচর্যার সামাজিক ব্যবসা মডেলের একটি পাইলট প্রকল্প পরিচালনায় ব্যয় করা হবে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক জনাব আসিফ সালেহ্, ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি-জেনারেল জনাব এডওয়ার্ড মা, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (বিআইইডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইরাম মারিয়াম এবং ব্র্যাক ও ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাবৃন্দ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার মাধ্যমে উত্তম বিশ্ব সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৬ সালে হংকংয়ে ইদান প্রাইজ প্রবর্তন করা হয়। চীনভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি টেনসেন্ট-এর অন্যতম কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠাতা ড. চার্লস চেন ইদান এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যারা শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের উদ্ভাবনমূলক কাজ করছেন এবং সেগুলোর সফল প্রয়োগ ও বিস্তার ঘটাতে ভূমিকা রাখছেন তাঁদের হাতে এই মর্যাদাসূচক স্বীকৃতি তুলে দেয় ইদান প্রাইজ ফাউন্ডেশন।
পুরস্কারটি ‘ইদান প্রাইজ ফর এডুকেশন রিসার্চ’ এবং ‘ইদান প্রাইজ ফর এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট’ এই দুই ভাগে দেওয়া হয়।