ইউরোপ প্রবাসী শিক্ষক আমিনুল ইসলাম শুক্রবার দুপুরে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। জীবনের নানা ঘটনার গল্প বলে অনুপ্রেরণামূলক পোস্টটি তিনি শেষ করেছেন ‘পরাজিতদের কেউ মনে রাখে না’ বলে। আমিনুল ইসলামের ফেসবুক পোস্ট:
ক্লাস নিচ্ছি, পৃথিবীর নানান দেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরা সামনে বসে আছে। এখানে যেহেতু চার ঘণ্টার ক্লাস নিতে হয়, তাই মাঝখানে ১০-১৫ মিনিটের একটা ব্রেক দেয়ার নিয়ম আছে।
সন্ধ্যায় একটা পার্টি ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকেই আয়োজন করা হয়েছে। ব্রেকে আমি ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলাম
-তোমরা কি আসছ নাকি সন্ধ্যার পার্টিতে?
কেউ “হ্যাঁ”, কেউ “না” বলছে। তো এক বাংলাদেশি ছাত্র জিজ্ঞেস করেছে
– আপনি আসছেন তো?
-আমি এখনও ঠিক সিওর না। সন্ধ্যায় একটা কাজ আছে। দ্রুত শেষ করে ফেলতে পারলে যাবো ভাবছি।
ছেলেটা এরপর খানিক সঙ্কোচের সঙ্গেই বলেছে
– পার্টিতে আমাদের বাংলাদেশিদের কাছে কিন্তু আপনিই মূল আকর্ষণ। আপনি না আসলে কিন্তু একদম চলবে না। আসতেই হবে।
আমি আর কিছু বললাম না। খানিক হেসে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ইটালি থেকে আসা এক ছাত্র বলল
-হ্যাঁ, তুমি বোধকরি বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশিদের কাছে বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয়।
আমি শুনে একটু অবাকই হলাম। ইটালি থেকে আসা ছাত্র হঠাৎ এই কথা বলছে কেন! জিজ্ঞস করলাম
– তুমি কেন বলছ এ কথা?
ছেলেটার ইংরেজি খানিক ভাঙা। একটু গুছিয়ে নিয়ে বলছে
-আমি গত সপ্তাহে জাহাজে করে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় এক বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সে বলছিল- তোমাকে সে চেনে। তুমি নাকি লেখক। সে তোমার লেখা নিয়মিত পড়ে। বাংলাদেশে অনেকেই নাকি তোমাকে চেনে- জানে।
আমি হেসে বললাম
-ও আচ্ছা! হ্যাঁ, লেখালেখির সূত্রে কিছু মানুষজন হয়ত আমাকে চিনতে পারে।
এরপর আর কথা হয়নি। বিরতি শেষে আবার ক্লাস নিতে হয়েছে।
সন্ধ্যায় পার্টিতে গিয়েছি। যে যার মতো করে খাচ্ছে-দাচ্ছে, নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ ইউক্রেন থেকে আসা এক ছাত্রী, আমার টেবিলে এসে বলছে
-আমি কি তোমার সঙ্গে খানিক সময় কথা বলতে পারি?
-নিশ্চয়।
-অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম বলবো। আজ যেহেতু সুযোগ পেয়েছি, তাই ভাবলাম বলেই ফেলি।
-হ্যাঁ বলো।
-আমি তোমরা লেখার একজন ফ্যান। আমি নিয়মিত তোমার লেখা পড়ি।
আমার চোখ তো কপালে উঠার জোগাড়! জিজ্ঞেস করলাম
-তুমি আমার লেখা পড় কই থেকে? তাছাড়া আমি তো বেশিরভাগ লেখাই বাংলাতে লিখি। তুমি কি করে পড়?
-ফেসবুকে আমি তোমাকে অনেক দিন থেকেই ফলো করছি। তোমার সব লেখাই আমি ট্রান্সলেট করে পড়ার চেষ্টা করি। হয়ত খুব ভালো বুঝা যায় না। তবে লেখার মূল জায়গা গুলো আমি ধরতে পারি।
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার ধারণা যে কোন লেখকের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া হচ্ছে- যখন কেও এসে জানান দেয়- আমি আপনার লেখা পড়ি এবং লেখা পড়তে আমার ভালো লাগে।
মেয়েটা এবার বলছে
-তুমি কি আমাকে ছোট একটা গান লিখে দিবে?
– কেন না? নিশ্চয়।
-তবে গানটা কিন্তু তোমাকে আমার সঙ্গে গাইতে হবে। আমি জানি তুমিও গান গাইতে পারো।
আমি হেসে বললাম
-না না, আমি গান গাইতে পারি না সেভাবে। চেষ্টা করি আরকি।
তবে আমি মেয়েটাকে কথা দিয়েছি তাকে আমি একটা গান লিখে দিব।
শুনেছি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফির জন্মদিন আজ। ওর জন্মদিন উপলক্ষে একটা ভিডিও দেখলাম কিছুক্ষণ আগে। আমার ঠিক জানা নেই, ভিডিওটা কবে বানানো। তবে আমার চোখে আজই পড়েছে।
প্রথম-আলোর বিখ্যাত ক্রীড়া-সাংবাদিক উৎপলদা মাশরাফির সাক্ষাৎকার নিচ্ছে; তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে
– দেশের মানুষজন তো আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আপনি অনেকের কাছে তাদের জীবনের হিরো।
মাশরাফি তার স্বভাবসুলভ খুব বিনীত ভাবে বলছে
-হ্যাঁ, শুনতে ভালোই লাগে। তবে আমার মনে হয় না আমাকে হিরো মনে করার কোন কারণ আছে!
এরপর মাশরাফি একে একে চারজনের নাম বলেছে। যেই চারজনকে মাশরাফি নিজে “হিরো” মনে করে।
এদের একজনে দুই পা বলতে গেলে নেই। এরপরও এই ছেলে জীবন সংগ্রামে থেমে থাকেনি। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কাজে বেড়িয়ে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলাও করে বেড়াচ্ছে। তার যে দুই পা নেই, এই ব্যাপারটা জীবন যুদ্ধে তাকে থামাতে পারেনি।
আরেক মেয়ের অল্প বয়েসে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিলো। তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। এই মেয়ের ইচ্ছে ছিল পড়াশুনা করে বড় হবার। কিন্তু কিভাবে সম্ভব- বাবা-মার অমতে গিয়ে সব কিছু চালিয়ে যাবার। তারা যে তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু এই মেয়ে ঠিকই তার নিজের বিয়ে নিজে ঠেকাতে পেরেছে। পুলিশে খবর দিয়েছে; যাতে এই বাল্য বিবাহ রোধ করা যায়। এই মেয়েটার এখন ইচ্ছে- সে বড় হয়ে এমন সব মেয়েদের পাশে দাঁড়াবে।
মাবিয়া নামের মেয়েটার গল্পও এসছে। মেয়াটা সাফ গেমসে বাংলাদেশের হয়ে ভারোত্তোলনে স্বর্ণ পদক জিতেছিল। মনে আছে সেই মাবিয়ার কথা? স্বর্ণ পাবার পর যখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল- মেয়েটা তখন পতাকার দিকে তাকিয়ে স্যালুট জানাচ্ছে, আর তার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
চোখের এই জল ছিল- তার জীবন সংগ্রামের গল্প। প্রায় ঝুপড়ি ঘরে থেকে, যেই ঘরের নিচে’ই আবার পানি! প্রতিদিন বেঁচে থাকার তাগিদে যখন যুদ্ধ করতে হচ্ছে; তখনও সে তার প্র্যাকটিস চালিয়ে গিয়েছে। স্বর্ণ পদক পাবার পর আমি নিজেও এই মেয়েটার ইন্টার্ভিউ নিয়েছিলাম।
এরা হচ্ছে মাশরাফির “হিরো!” কারন হাজারো বাঁধা পেরিয়ে জীবন যুদ্ধে এরা থেমে থাকেনি। শুধু নিজের জন্য’ই না, দেশের জন্যও এরা কিছু না কিছু করছে বা করার ইচ্ছে আছে তাদের।
আমি এই ভিডিও’টা এই নিয়ে পাঁচ বার দেখে ফেলেছি। যতবার দেখছি ততবার আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তবে সত্য বলতে কোন সঙ্কোচ নেই। আজ অবশ্য আমার চোখের জল এদের গল্প শুনে গড়িয়ে পড়েনি।
জল গড়িয়ে পড়ছে- আমার নিজের জন্যই। আমারও একটা গল্প আছে। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার গল্প। মানুষের ঘৃণা, অবহেলা আর হাসির পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার গল্প।
স্কুল-কলেজে পড়তে গিয়ে কতোটা যুদ্ধ এই আমাকে করতে হয়েছে, সে কেবল আমার মাই জানতেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা; সেই পড়াশুনা শেষ করে বিদেশের পড়াশুনা আরও কতো কি!
এইসব’ই আমাকে করতে হয়েছে- না বলা গল্প’টা বয়ে বেড়িয়ে! মা ছিলেন, সব সময় বলতেন- তোমার তো এতে কোন হাত নেই। তুমি তোমার মতোই থাকবে।
চলতি পথে আমি দেখেছি, মানুষ হয়ে জন্মানোর পর স্রেফ নিজেকে প্রকাশ করার অপরাধে কতোটা ঘৃণা আর অবহেলা আমাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। সেই প্রকাশটাও হয়ত পুরোপুরি করা হয়ে উঠেনি!
এইতো বিদেশে আমাদের এই ছোট্ট শহরে পরিচয় হয়েছিল একজনের সঙ্গে। আহা, কতো মধুর ব্যাবহার, দিনে-রাতে কেবল প্রশংসার বাক্য, ভালোলাগার গল্প, ভালোবাসার গল্প।
আমি ভেবে বসলাম- বাহ, কি চমৎকার মানুষ! সব সময় প্রশংসা করছে। স্যার, স্যার বলে বেড়াচ্ছে!! দিনে-রাতে উঠতে বসতে বলছে- আমার আপনাকে খুব ভালো লাগে, আমি আপনাকে ভালোবাসি..! আরও কতো কি।
ভেবে বসলাম- এর কাছে হয়ত নিজেকে খানিক প্রকাশ করা যায়।
বাকি গল্প’টা অবশ্য সেই এক’ই! ঘৃণা এবং অবহেলা’র!
স্কুলে ভর্তি হয়েছি- কিছু বুঝতে পারি না; এই জন্য সবাই হাসাহাসি; স্যার’রা বলে দিলেন একে দিয়ে স্কুল পড়াশুনা হবে না! বাসায় রেখেই পড়ান!
কলেজে গিয়েছি- যে কোন উঁচু শব্দ শুনলে কেঁপে উঠছি কিংবা অন্যান্য ছেলে-পেলেদের মতো রেল-লাইনে বসে আড্ডা দিতে পারি না, কারণ ভয় লাগে কখন না ট্রেন চলে আসবে; এই নিয়ে সবাই হাসা-হাসি করে!
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি- সবার সাথে মিশতে পারি না, এই নিয়ে মানুষজন হাসাহাসি করছে কিংবা অন্য কিছু ভেবে বসে আছে! ক্লাস মেট’রা তো মাস্টার্সের আগ পর্যন্ত আমাকে বোধকরি ভিনগ্রহের প্রাণী মনে করত!
কারো অবশ্য গল্প’টা শুনার সময় হয়নি।
তাই বলে আমি থেমে থাকিনি। আমি আমার মতো করেই এগিয়েছি। আমার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন মাস দুয়েক আগে। তবে তিনি আমাকে সেই ছোট বেলা থেকে’ই শিখিয়েছেন
-মানুষজন তোমাকে ঘৃণা করুক, অপছন্দ করলে করুক। কিন্তু তুমি সবাইকে ভালবাসবে। সবার সঙ্গে ভালো ব্যাবহার করবে। দেখবে, অন্যরাও তোমার সঙ্গে ভালো ব্যাবহার করবে।
আমি আমার মা’র কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনে জীবনে এতদুর পর্যন্ত চলে এসছি।
যেই ছেলেটার স্কুলের পড়াশুনা’ই বন্ধ হয়ে যাবার কথা ছিল, সেই ছেলেটা এখন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা হাজারো ছাত্র-ছাত্রীদের সমাজ এবং সামাজিক মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে এবং ভাবতে শেখাচ্ছে।
মাঝখান থেকে কেবল গল্প’টা কারো শুনার সময় হয়নি কিংবা বলার সুযোগ হয়নি!
ইটালি থেকে আসা যেই ছেলে’টা বলছিল- তুমি তো অনেক জনপ্রিয়! ছেলেটা’কে বলা হয়ে উঠেনি
-হ্যাঁ, প্রতিদিন হাজারো মানুষ আমার লেখা পড়ে, কতো মানুষের গল্প আমি আমার নিজের লেখায় তুলে ধরি; মাঝখান থেকে স্রেফ আমার গল্প’টাই যে আর বলা হয়ে উঠেনি!
কি করে বলবো?
উৎপল দা, আপনি তো আমার বন্ধু তালিকাতে’ই আছেন। মাশরাফির গল্প তো শুনেছেন। আমার গল্পটা কি শুনবেন? মাশরাফি, তুমি কি শুনবে আমার গল্প? তুমি করেই বললাম। বয়েসে তুমি আমার ছোটই হবে।
ভয় হয় যে! আবার না ঘৃণার পাত্র হয়ে যাই!
মাশরাফি যেই চারজনের নাম বলেছে, যারা সংগ্রাম করে জীবন যুদ্ধে সফল হয়েছে বা হচ্ছে কিংবা হাজারো বাঁধা পার হয়ে সামনে এগিয়েছে; তারা তাদের গল্পটা অন্তত বলতে পেরেছে।
তবে পৃথিবী নামক এই গ্রহে অন্য আর দশ জন মানুষের মতো দেখতেই কিছু মানুষ আছে; যাদেরও একটা করে আলাদা গল্প আছে; যেই গল্প বলতে নেই।
সেই গল্প গুলো না বলা’ই থেকে যেতে হয়। এরপরও থেমে যাবার সুযোগ নেই। এগিয়ে যেতে হবে। হয়ত একদিন কেউ শুনবে তাদের গল্প, সেই প্রতীক্ষায়। তবুও থেমে যাওয়া যাবে না।
উদাহরণ দিতে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। এই যে আমার এতো লম্বা-লম্বা, বিশাল লেখা গুলো আপনারা প্রতিদিন আপনাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে পড়েন, এর কারনও হচ্ছে- সফলতা! কারন জীবনের চলতি পথে কিছু ভণ্ড-প্রতারকের প্রতারণা থেকে শুরু করে মানুষের ঘৃণা-অবহেলার পাত্র হবার পরও আমি কিছুটা হলেও সফল হয়েছি।
এই আমিই যদি আমার আজকের সামাজিক অবস্থানে না থেকে অতি সাধারণ সামাজিক অবস্থানে থাকতাম- তাহলে আমার এই একই লেখা আপনাদের কাছে সাদা-মাটা মনে হতো! তখন হয়ত আমার লেখা পড়তেও ভালো লাগতো না।
তাই থেমে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। কারণ, পৃথিবী নামক এই গ্রহে পরাজিত মানুষদের কেউ মনে রাখে না। আমাদের গল্প গুলোও তাই স্রেফ সফল হবার গল্প!