চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সোমবার যে স্থানে পদদলিত হয়ে ৯ নারীর মৃত্যু হয়েছে; এই স্থানে আগেও এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০০৫ সালে এখানেই যাকাত নিতে এসে পদদলনে নিহত হয় ৮ জন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েক বছরে এ ধরনের ঘটনার আরো নজির রয়েছে।
যাকাত ও ইফতার সামগ্রী নিতে গিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনায় অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে জেলা প্রশাসন।
নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব ঘাটিয়া ডাঙ্গায় কবির স্টিল (কেএসআরএম) গ্রুপের মালিকের বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভেতরে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর এই ঘটনা ঘটে, যাতে আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন।
আজকের মতো ২০০৫ সালের অক্টোবর এই কেএসআরএম মালিকের বাড়িতে যাকাত নিতে এসে মৃত্যু হয় ৮ জনের।
সোমবারের ঘটনাটি তদন্তে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি অব্যবস্থাপনার জন্যই এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ইলিয়াস হোসেন আরও বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদুল কবিরকে প্রধান করে এই তদন্ত কমিটি আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিবে। এ ঘটনায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এর আগে, গতবছর ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানির মেজবানে ভিড়ের মধ্যে পদদলিত হয়ে মৃত্যু হয় ১০ জনের।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে ময়মনসিংহে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে ২৭ নারী ও শিশু মারা যান।
এর আগে, ১৯৮০ সালে ঢাকার জুরাইনে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ১৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
১৯৮৩ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যাকাতের টাকা নিতে গিয়ে ভিড়ের চাপে পড়ে ৩ শিশু মারা যায়।
১৯৮৭ সালের ২৩ মে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় সরকারিভাবে যাকাত দেওয়ার সময় ব্যাপক লোক সমাগম হয়। এক পর্যায়ে জনগণ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এসময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় মধ্যে পড়ে ৪ জন মারা যায়।
১৯৮৯ সালের ৫ মে চাঁদপুরে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত মারা যায় ১৪ জন। এসময় অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়।
যাকাত নিতে গিয়ে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামে ১৯৯০ সালে। ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পাহাড়তলীর আবুল বিড়ি ফ্যাক্টরিতে যাকাত নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ৩৫ জন নিহত হয়। এসময় আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ।
২০১৪ সালের ২৫ জুলাই রমজানের ঈদের দুইদিন আগে মানিকগঞ্জের গার্লস স্কুল রোডে ব্যবসায়ী মাহবুব হাসান মোর্শেদ রুনুর বাড়িতে যাকাত প্রদানের সময় পদদলিত হয়ে জামেলা খাতুন ও হাসনা বেগম নামে দুই হতদরিদ্র নারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
একই দিন বরিশালের কাঠপট্টি এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে যাকাত প্রদানের সময় হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে ফিরোজা ও নুপুর নামে দুই নারীর মৃত্যু হয়।
আর ২০১৫ সালের মার্চ মাসে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পুণ্যস্নানের সময় পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়।
বিশেষত, চট্টগ্রামে রোজা ও ঈদের আগে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উপলক্ষে আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে দুস্থদের মধ্যে দানের টাকা ও বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণের রেওয়াজ আছে ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে।
এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে মেজবানে দাওয়াত দিয়ে পুরো গ্রামের মানুষকে খাওয়ানোর রেওয়াজও জেলাটিতে পুরনো।
পদদলনে মৃত্যুর ঘটনাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে যাকাত প্রদানের ঘটনাগুলোর সময়। আর এক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করাকেই দায়ী বিবেচনা করা হয়।
এমন একটি মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাকাত প্রদানের উদ্যোগ নিলে তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারকে অবহিত করতে হবে।
“যাকাত প্রদানের দিন সেখানে পর্যাপ্ত পুলিশী নিরাপত্তা রাখতে হবে। যাকাত প্রদানের আগে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখানে যাকাত দেওয়া করা যাবে কিনা-এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারকে রিপোর্ট দিবে। ”
কিন্তু বাস্তবে পুলিশের এমন নিয়মের প্রতিফলন দেখা যায় না। আর পদদলনে মৃত্যুর ঘটনাও থামছে না।