দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ষাটের দশকের মধ্যভাগে। একটি মাত্র টেলিভিশন স্টেশন বাংলাদেশের মানুষের প্রয়োজন মিটিয়েছে বহু বছর। আজ বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের জগৎ সম্প্রসারিত ও প্রাণবন্ত। কিন্তু এই পর্যায়ে আসতে যে দু-তিনটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল পথনির্মাতার ভূমিকা পালন করে চ্যানেল আই তাদের অন্যতম। সাফল্যজনক ভাবে ঊনিশ পেরিয়ে কুড়ি বছরে পড়লো চ্যানেল আই। তাকে তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
১৯৯৯ সালের ১ অক্টোবর যাত্রা শুরু করার সময় থেকেই মিশনারি উদ্দীপনা নিয়ে চ্যানেল আইয়ের কর্ণধার ও কর্মকর্তা এবং কলাকুশলীরা কাজ করতে থাকেন। তাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। একটি মাত্র সরকারি টেলিভিশন দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। সরকার নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন কেন্দ্রের বৈচিত্রহীন একঘেঁয়ে সংবাদ পরিবেশন ও অনুষ্ঠানমালা দর্শককে পরিতৃপ্ত করতে পারেনি। টেলিভিশন শুধু বিনোদনের জন্য নয়, এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রচার মাধ্যম, যা জনগণের চেতনার মান বাড়ায়।
গণতন্ত্রকামী মানুষ দেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে চায়। সে জন্য সংবাদকে তারা খুবই গুরুত্ব দেয়। চ্যানেল আই সংবাদ পরিবেশনে বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে আসছে প্রথম দিন থেকেই। গত দুই দশকে দেশে বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলন- সংগ্রাম হয়েছে। সেগুলোর নির্ভরযোগ্য সংবাদ যে শুধু বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে পরিবেশন করেছে তাই নয়, সেসব ঘটনার বিশ্লেষণ করা হয়েছে নিরপেক্ষতার সঙ্গে। তার ফলে চ্যানেল আই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঘরে ঘরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষ সত্য জানতে চায়, শুধু সরকারের উন্নয়নের প্রচারণা নয়, জনগণের আবেগ অনুভূতি আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের কথা শুনতে চায়। সে কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে এসেছে চ্যানেল আই। সেজন্য বেড়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা।
চ্যানেল আই এর যে বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখে পড়েছে তা হলো, বাঙালির ইতিহাস- ঐতিহ্য ও বাঙালি সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা। দেশের শিল্প সংস্কৃতির জগতে খ্যাতিমান ও গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটেছে চ্যানেল আইতে। শুধু মূলধারার রবীন্দ্র সংগীত, নজরুলগীতি ও পল্লীগীতি নয়, বাঙালী সংস্কৃতির সবগুলো দিকই প্রাধান্য পায় এ চ্যানেলে। ‘গানে গানে সকাল শুরু’ আমার প্রিয় একটি অনুষ্ঠান। শুধু যে এখানে প্রতিষ্ঠিতরাই অংশ নিচ্ছেন তা নয়, অনেক নতুন শিল্পী এখানে সংগীত পরিবেশন করে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। এক্ষেত্রে বলতেই হয়, চ্যানেল আই গত ২০ বছরে শিল্পী গড়ার এক কারিগর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এটি অনেক বড় কাজ। শিল্পের যেকোনো শাখায় কৃতি, প্রতিভাবান ও জনপ্রিয়দের অধিকাংশেরই সুতিকাগার চ্যানেল আই। আজ কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী, আবৃত্তিশিল্পীদের মধ্যে যারা প্রথম সারিতে তাদের বড় অংশটি গড়ে উঠেছে চ্যানেল আই এর প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ঐতিহ্য, প্রবণতা, শুদ্ধাচার সবকিছুর সঙ্গে তালমিলিয়ে শিল্পী গড়ার কাজটি অনেক মহৎ প্রয়াস। এক্ষেত্রে চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষের অবদান অনস্বীকার্য।
চ্যানেল আই’র উদ্যোগ বহুমুখী ও বৈচিত্রপূর্ণ। আমি একজন পরিবেশকর্মী হিসেবে লক্ষ্য রেখেছি পরিবেশের উন্নয়নে এবং পরিবেশ বিপর্যয় রোধে চ্যানেল আই’র ভূমিকা। তার প্রকৃতি ও জীবন বিষয়ক অনুষ্ঠানমালা জনগণের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইতোমধ্যে তা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশ। কৃষি ও কৃষক বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ডই শুধু নয়, প্রাণ। চ্যানেল আই’র অন্যতম কর্ণধার শাইখ সিরাজের পরিকল্পিত ও পরিচালিত ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তার পেছনে যে কৃষকের হাত সে কৃষকদের সাফল্যের গাঁথা গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে শাইখ সিরাজ অক্লান্ত পরিশ্রম করে চ্যানেল আই’র পর্দায় বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। তার এই অসামান্য ভূমিকার রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা তার এই অনুষ্ঠান কৃষক সমাজে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। প্রাক-বাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট, কৃষকের বাজেট’, ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ প্রভৃতি অনুষ্ঠান শুধু যে গ্রামের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় তা নয়, অভিনবত্বের কারণে সব শ্রেণীর দর্শকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
বাঙালির ঐতিহ্যের অনেক কিছুই পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। তার একটি গ্রামীন মেলা। সেটিকে জনপ্রিয় করে তুলছে চ্যানেল আই। তার উদ্যোগে এখন প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বৈশাখী মেলা, রবীন্দ্র মেলা, নজরুল মেলা, পৌষ মেলা, বিজয় মেলা, বাংলা নববর্ষ প্রভৃতি। যা হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে সম্প্রচারিত হচ্ছে। এইসব অনুষ্ঠানের প্রভাব জনজীবনে অসামান্য।
বাঙালি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশ বহু ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তার মানুষের বাসভূমি। আদিবাসী মানুষের বৈচিত্রময় জীবন ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে আয়োজন করছে পার্বত্য লোকজ মেলা।
শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে চ্যানেল আই’র ভূমিকা সর্বজন প্রশংসিত। এক্ষেত্রে চ্যানেল আই’র আরেক কর্ণধার শিশু সাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগরের ‘ছোট কাকু’ খুবই জনপ্রিয়। কেকা ফেরদৌসীর রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান দেশ বিদেশের মহিলাদের চ্যানেল আই এর সামনে বসিয়ে রাখতে বাধ্য করে। প্রচারিত হচ্ছে সুস্থ জাতি গঠনমূলক আরো বহু বৈচিত্রময় অনুষ্ঠান।
ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড-এর চলচ্চিত্র ১৭০টিরও বেশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে। প্রায় প্রতিবছর সিনেমা অস্কার প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে ৪৮টি। এসব সামান্য অর্জন নয়। বাঙালির রাজনীতিতে অপার আগ্রহ, তারা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ পছন্দ করে, পছন্দ করে যুক্তিযুক্ত বিতর্ক। জিল্লুর রহমান উপস্থাপিত টকশো অনুষ্ঠান ‘তৃতীয় মাত্রা’ খুবই জনপ্রিয়। বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের বিতর্ক যেমন উপভোগ্য তেমনি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সহায়ক।
চ্যানেল আই এর কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি খুবই দীর্ঘ। মননশীল ও সৃষ্টিশীল উন্নত জাতি গঠনে চ্যানেল আই বিরামহীন কাজ করছে। ভাষাহীন নিপীড়িত মানুষের কথা তুলে ধরছে তার অনুষ্ঠানগুলোতে, ফলে তারা রাষ্ট্র থেকে পাচ্ছে প্রতিকার, ন্যায় বিচার। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাখছে ভূমিকা।