একজন নারী, একজন কন্যা ও একজন মা হিসাবে নুসরাত হত্যার ন্যায়বিচার পেয়ে আবেগ আপ্লুত হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এত দ্রুত সময়ে বিচার পাওয়া নিয়ে কিছুটা হলেও সংশয় ছিল দেশবাসীর। কারণ হলো অতীত ইতিহাস। এদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচার প্রলম্বিত হয় দীর্ঘসূত্রতার কারণে। কিন্তু নুসরাত হত্যার বিচার অন্য এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঠিক দিকনির্দেশনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পারদর্শিক তদন্ত রিপোর্ট মানুষকে আশা জাগিয়েছিল। বর্বরোচিত ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ১২ জন আসামির তদন্তকালীন জবানবন্দিতে। পিবিআইয়ের চৌকস ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করে, এদেশের পুলিশ বাহিনী স্বচ্ছতার সাথে কাজ করলে মানুষ অন্যায়ের কাছে বলি হবে না।
মানুষ নামের অমানুষ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ধর্ম ও শিক্ষাঙ্গনকে কুলষিত করেছে তার অপকর্ম দিয়ে। আর নুসরাত সাহসী হয়ে তার শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করেছিল এটাই তার অপরাধ। তাই নরকের কীট সিরাজকে বাঁচাতে তার দোসরেরা নুসরাতকে পুড়িয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন সহ সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহিউদ্দিন শাকিল।
সরকার, পুলিশ প্রশাসন ও দেশের মানুষের বিবেককে কাঁদিয়েছে নুসরাত। দগ্ধ শরীর নিয়ে ১০দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করা সেই দৃশ্য মানুষ ভুলে যাবার আগেই দ্রুত বিচার করে আদালত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছে। শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত লড়াই করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মেয়েটি মায়ের বুক খালি করে চলে গেছে। তবে সে হারেনি। প্রমাণ করেছে অন্যায়কে মুখ বুজে সয়ে গেলে এ সমাজে মেয়েরা নানাভাবে নির্যাতিত হবে।
ধর্ষণের কঠোর সাজা থাকা সত্ত্বেও নুসরাতের ঘটনার পরেও থামেনি এ অপরাধমূলক কাজ। এমনকি আজকের রায়ের পর এদেশ থেকে বর্বরতা বন্ধ হয়ে যাবে তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না রাষ্ট্র। কারণ এ দেশের আদালতে নুসরাতের বিচার হলেও এখনো তনুসহ হাজারও নারী হত্যার বিচার হয়নি। যার নানাবিধ কারণের মধ্যে রয়েছে মান সম্মানের ভয়ে ঘটনা গোপন করা, রাজনৈতিক প্রভাব, মামলার দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব, সমঝোতা করা ইত্যাদি।
বিচারিক আদালতে ধর্ষণের মামলার অবস্থার হতাশাজনক চিত্র পাওয়া যায় বেসরকারি সংগঠন নারী পক্ষের একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে।
২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা, জামালপুর, ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ জয়পুরহাট, নোয়াখালীতে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে নারীপক্ষ। এসময় গবেষণাকর্মীরা ৭টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১১ হাজার ৮৬৪টি মামলা পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩’-এর অধীনে ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ধর্ষণ সংক্রান্ত ৯২০টি, ধর্ষণচেষ্টা সংক্রান্ত ১১৭টি, যৌন পীড়ন ৩৬৪টিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মোট চার হাজার ৪৯৬টি মামলা হয়।
সিরাজগঞ্জে ধর্ষণ সংক্রান্ত ৫৩৬টি, ধর্ষণচেষ্টা ১৬৮টি, যৌন নিপীড়ন ৯১টিসহ মোট এক হাজার ৭৯৮টি মামলা দায়ের করা হয়। জামালপুরে ধর্ষণ সংক্রান্ত ৬০৭টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩২৫টি, যৌন নিপীড়ন ৭৭টিসহ মোট দুই হাজার ২৩১টি মামলা করা হয়। ঝিনাইদহে ধর্ষণ সংক্রান্ত ১৭৭টি, ধর্ষণচেষ্টা ৮১টি, যৌন নিপীড়ন ৬০টিসহ মোট মামলা হয়েছে ৭১৬টি। জয়পুরহাটে ধর্ষণ সংক্রান্ত ৯২টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩২টি, যৌন নিপীড়ন ২৫টিসহ মোট ৬৫৬টি মামলা দায়ের করা হয়। নোয়াখালীতে ধর্ষণ সংক্রান্ত ২৬৫টি, ধর্ষণচেষ্টা ১৫১টি, যৌন নিপীড়ন ১১৪টিসহ মোট এক হাজার ৯৬১টি মামলা দায়ের করা হয়। ওই সময়ের মধ্যে ছয় জেলায় সাজা পেয়েছে ধর্ষণ মামলায় ৪ জন এবং অন্যান্য মামলায় ১৮ জন।
প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের সংবাদ যে পরিমাণে প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আসে তাতে শিহরিত হয় জনজীবন। কন্যা সন্তান এখন ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। এ পরিস্থিতিতে নুসরাত হত্যার বিচারের রায় রাতের অন্ধকার সরিয়ে দিনের আলো রেখা জ্বালিয়েছে। আর সে আলোর শিখাটা যেন সকল আদালতে ন্যায়ের প্রতীক হয়ে জ্বলে এ প্রত্যাশা প্রতিটি বিবেকবান মানুষের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)