অত্যন্ত গরীব মানুষগুলোর শুধু টাকারই অভাব নেই, অভাব আরও অনেক কিছুর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দারিদ্র্য থেকে বের হতে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম জ্ঞান থাকে না। থাকে না এ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা। এমনকি তাদের নিজেদের যোগ্যতা নিয়েও থাকে আত্মবিশ্বাসের অভাব।
২০১৯ সালে অর্থনীতিতে অন্যতম দুই নোবেলজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং তার স্ত্রী এসটার ডুফলো ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাদের ‘পুওর ইকোনমিকস’ বইয়ে বলেছিলেন, এর ফলে অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত কিছু দক্ষতা, ইচ্ছাশক্তি আর দৃঢ়তা। আর এ কারণেই দিনে সোয়া এক মার্কিন ডলার বা ১০৬ টাকারও কম আয় করা চরম দরিদ্র মানুষগুলোকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভেঙে বের করে আনাটা এতটা কঠিন।
এই ‘দারিদ্র্যের ফাঁদ’ থেকে কীভাবে ধাপে ধাপে একজন মানুষকে বের করে আনা যায়, সেটাই পরীক্ষানির্ভর গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন এই দম্পতি এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় তাদের সঙ্গী আরেক নোবেল বিজয়ী মাইকেল ক্রেমার।
আর অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের এই গবেষণায় উঠে এসেছে ব্র্যাকের অতি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সাফল্য। কেননা যে পদ্ধতিটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে তারা গবেষণায় নেমেছিলেন তার উদ্ভাবক বাংলাদেশের এই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটি (এনজিও)।
ভারতীয় বাঙালি অভিজিৎ ব্যানার্জি, ফ্রান্সের এসটার ডুফলোসহ আরও বেশ কয়েকজন গবেষক মিলে ২০১৫ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যেখানে অতি দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পগুলোর হতাশাজনক চিত্র বেরিয়ে আসে।
ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, অতি দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে সফল অর্থনৈতিক স্কিমগুলোও কিছু সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রেই কার্যকর বলে দেখা যায়। যেমন, ক্ষুদ্রঋণ তুলনামূলক উদ্যোগী মানসিকতার মানুষের ক্ষেত্রে কাজে লাগে, যারা দরিদ্র হলেও অতি দরিদ্র না।
একইভাবে শিক্ষার বিনিময়ে অর্থের প্রকল্পটিও বেশ কার্যকর, এক্ষেত্রে সেই এলাকায় একটি সক্রিয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। আবার ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি ও সংস্কৃতির কারণে একই পদ্ধতি এক দেশে সফল হলেও আরেক দেশে পুরোপুরি ব্যর্থ হতে পারে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করাটাই সবচেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে।
সেই গবেষণাপত্রে গবেষকরা এমন একটি কৌশল শনাক্ত করার দাবি করেন যা মোটামুটি সব ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় অবিরত সাফল্য দেখাতে সক্ষম। ৬টি দেশের ১০ হাজারেরও বেশি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ওপর টানা ৭ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে এ সিদ্ধান্তে আসেন তারা।
গবেষণার সিদ্ধান্তে বলা হয়, অতি দারিদ্র্যের মতো বড় একটি সমস্যাকে ছোট ছোট মৌলিক প্রশ্নে ভাগ করে ধাপে ধাপে, তবে টানা একটা সময় ধরে তার সমাধান করে যেতে হবে। তাহলেই দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া সম্ভব।
তারা যে প্রক্রিয়ায় মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষানির্ভর গবেষণাটি চালান সেই প্রক্রিয়াটি মূলত এসেছিল ব্র্যাকের একটি প্রকল্প থেকে। গবেষণাপত্রে এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে ব্যাখ্যাসহ। ব্র্যাক এই প্রকল্পটির নাম দিয়েছে ‘গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’।
এই প্রকল্পের অধীনে কোনো একটি এলাকা থেকে যাচাইবাছাইয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোকে শনাক্ত করেন ব্র্যাকের কর্মীরা। এরপর সেই পরিবারগুলোকে সুযোগ দেয়া হয় উৎপাদনশীল সম্পদ, অর্থাৎ গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদির একটি তালিকা থেকে একটিকে বেছে নিতে, যেটি তাদেরকে পালন করতে দেয়া হবে।
বেছে নেয়ার পর ওই সম্পদটি তাদেরকে দেয়ার পাশাপাশি পরিবারটিকে সংস্থার পক্ষ থেকে সেই পশুপাখি পালনের জন্য যাবতীয় খরচসহ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংসারের ন্যূনতম খরচ সরবরাহ করা হয়, যেন অভাবের তাড়নায় পরিবারের সদস্যরা সেই পশুপাখি বিক্রি করে বা খেয়ে না ফেলে।
একই সঙ্গে সেই পশু বা পাখি লালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। পরের ধাপে জীবনধারণের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এছাড়া তাদের জন্য বিনামূল্যে সেভিংস অ্যাকাউন্ট এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও করে দেয়া হয় ওই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যেন তারা আয় করা অর্থ সঞ্চয় করে রাখতে পারে।
এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হলো ধাপে ধাপে একটি অতি দরিদ্র পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে আত্মনির্ভরতার দিকে নিয়ে যাওয়া, যাত্রা শুরু করা সময় তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে কতখানি পথ এগিয়ে দেয়া, যেন বাকি পথটুকু নিজে নিজে যাওয়ার যোগ্য তারা হয়ে উঠতে পারে।
ব্র্যাকের এই কৌশলটিকেই ঘানা, পাকিস্তান, ভারত, ইথিওপিয়া, হন্ডুরাস ও পেরুতে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা করে সাফল্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন এ বছরের অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী গবেষকরা।
উদাহরণ হিসেবে গবেষণাটি বলেছে, হাইফার ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফাম এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনের মতো বড় বড় এনজিওগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অতি দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার আশায় গরু, ছাগল বা মুরগি দিয়ে থাকে, যেন তারা দুধ-ডিম বিক্রি করে কিছু আয় করতে পারে।
কিন্তু যদি সাহায্য গ্রহীতা পরিবারগুলো এতটাই গরীব হয় যে ক্ষুধার জ্বালায় সেই দুধ-ডিম, বা পশুপাখির মাংস নিজেরাই খেয়ে ফেলে?
এজন্যই গ্র্যাজুয়েশন প্রকল্পে কোনো পরিবারকে শুধু মুরগি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় না। তার সঙ্গে সেই মুরগি পালনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দেয়া হয়, সাময়িকভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয় যেন তারা মুরগি বা ডিম খেয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকে।
পাশাপাশি প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা নিয়মিত তাদের সঙ্গে দেখা করে প্রশিক্ষণগুলো চাঙ্গা করে করে দিয়ে যান। প্রকল্পে অংশ নেয়া পরিবারগুলোর আত্মবিশ্বাস বাড়াতেও চেষ্টা করেন তারা।
ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন প্রকল্পের পদ্ধতিটি অর্থনীতিবিদরা তাদের গবেষণায় ৬টি দেশের দরিদ্রতম এলাকাগুলোতে পরীক্ষা করেন। এজন্য সেসব এলাকার স্থানীয় এনজিওগুলোর সহায়তা নেন তারা।
একেকটি এলাকায় মোটামুটি ১৮ মাস করে মোট ৭ বছর ধরে চালানো পরীক্ষাটিতে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন গবেষকরা। বাংলাদেশের ব্র্যাকের অতি দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের সাফল্য এভাবেই গবেষকদের নোবেল জয়ের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে পুরো বিশ্বের সামনে।