পাবলিক পরীক্ষায় ‘নৈর্ব্যক্তিক (এমসিকিউ) পদ্ধতি থাকবে কি থাকবে না’ তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাবিদরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের শিক্ষাবিদরা এমসিকিউ পদ্ধতির পক্ষে থাকলেও ওই পদ্ধতি থাকা উচিত নয় বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাবিদরা। এমসিকিউ পদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত থাকলেও সেরা স্কুল নির্ধারণ করার প্রচলন বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সবাই।
এমসিকিউ পদ্ধতি থাকবে, থাকবে না
এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দিলে মেধার সঠিক যাচাই হবে না উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আউয়াল খান বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দিলে মেধার সঠিক মূল্যায়ন হবে না। কারণ দেখা যায় যে, পাঠ্য বইয়ের সবগুলো অধ্যায় থেকেই রচনামূলক প্রশ্ন করা যায় না। আর অবশ্যই প্রতিটি অধ্যায় থেকে মাত্র একটি মুল পয়েন্ট নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। ফলে পরীক্ষায় শুধু রচনামূলক প্রশ্ন থাকলে শিক্ষার্থীরা শুধু বেছে বেছে কিছু অধ্যায় এবং অধ্যায়গুলোর মুল পয়েন্টগুলো পড়বে, বাকিগুলো পড়বে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের অধ্যাপক আব্দুল মালিক বলেন, এমসিকিউ নিয়ে শিক্ষকদের যে অনৈতিক তৎপরতা তা ঠেকাতে এটা বন্ধ করা হবে মাথা ধরা বন্ধে মাথা কেটে ফেলার মতো। এমসিকিউ নিয়ে যে অব্যবস্থাপনা তা বন্ধ করতে সরকারকে চেষ্টা করতে হবে।
অধ্যাপক মালিক আরও বলেন, এ পদ্ধতিতে প্রশ্নের গুণগত মান রক্ষা করা যায়, যা শুধু রচনামূলক প্রশ্ন দিয়ে করা যায় না। শিক্ষার্থীরা পুরো বইটি পড়ছে কিনা তা এই পদ্ধতিতে যাচাই করা যায়। তাই তিনি এমসিকিউ বন্ধ না করে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নের পক্ষে মত দিয়েছেন।
মাধ্যমিক পর্যায়ে কর্মরত রাজধানীর উদয়ন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. উম্মে সালেমা বেগম বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর এতো শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয় যে তাতে এমসিকিউ পরীক্ষার যথাযথ তত্ত্বাবধান সম্ভব হয় না। আর শিক্ষকরাও এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়। ফলে এটা উঠে যাওয়াই ভালো।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষিকা ড. শাহান আরা বেগম বলেন, এমসিকিউ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে পাবলিক পরীক্ষার হলে যে পরিবেশের তৈরি হয় তা বন্ধ করতে এই পদ্ধতিটি তুলেই দেয়া উচিত। অনেক ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবক তার কাছে এই এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দেবার দাবি জানিয়েছে বলেও জানান তিনি।
ড. শাহান আরা আরও বলেন, যারা পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিতে যায় তাদের পরীক্ষার হলে সমস্যা হয়। অনেক সময় শিক্ষকদের সাহায্যে মোটামুটি মানের ছাত্ররা পরীক্ষার হলে একে অপরকে উত্তর বলে দেয়। ফলে একটা বাজে পরিবেশ তৈরি হয় সেখানে।
সেরা স্কুলের তালিকা চান না
সেরা স্কুলের তালিকা উঠিয়ে দেয়ার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন সকল পর্যায়ের শিক্ষাবিদরা।
সেরা স্কুলের তালিকা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে অধ্যাপক মালিক বলেন, শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভ দিয়ে সেরা স্কুল নির্বাচন করা যায় না। অন্য বিষয়ও সেরা স্কুল নির্বাচনে বিবেচনায় আনতে হবে। এই তালিকা প্রকাশ করলে অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগীতা তৈরি হয় যা নিয়ে পরবর্তীতে অনেক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে।
সেরা স্কুলের তালিকা প্রকাশ বিষয়ে ভালো-মন্দ দু’দিক আছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল বলেন, এর মাধ্যমে স্কুলগুলোর মধ্যে পড়াশুনার মান ভালো করার একটি প্রতিযোগীতা তৈরি হয়। যারা সেরা হতে পারে না তারা তাদের পড়াশুনার মান বাড়িয়ে সেরা হওয়ার প্রতিযোগীতা করে। আরেকটি দিকও আছে, তা হচ্ছে তালিকা প্রকাশের কারণে সেরা যারা তাদের মধ্যে এক ধরণের আত্মাহমিকা তৈরি হয়। সব অভিভাবকরাও চান সেরা স্কুলগুলোতে সন্তানকে পড়াতে। স্কুলে ভর্তির সময় এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগীতা তৈরি করে অভিভাবকরা যা অনেক অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে। ভর্তি করতে না পারলে অভিভাবকরা হতাশ হন।
ভাল দিকটি ঠিক রেখে খারাপ দিকটির চর্চা যেন না হয় তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
উদয়ন স্কুলের অধ্যক্ষ ড. উম্মে সালেমা বলেন, সেরা স্কুলের তালিকা প্রকাশ করা হলে রেজাল্ট ভালো দেখানোর জন্য বেঁছে ভালো শিক্ষার্থী খুঁজে এনে স্কুলে ভর্তি করেন। এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আচরণের অংশ হতে পারে না। স্কুলের কাজ হলো যারা ওই স্কুলে ভর্তি হবে তাদের পরিচর্যা করা, ভালো ভাবে গড়ে তোলা।
সেরা স্কুলের তালিকা দেশের স্কুলগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগীতা তৈরি করছে বলেও জানান তিনি।
আগের সময়ে শিক্ষার্থীদের ‘বোর্ড স্ট্যান্ড’ করার নিয়মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ড. শাহান আরা বলেছেন, একসময় বোর্ডে যারা ভালো করতো তারা স্ট্যান্ড করতো। সেই ব্যবস্থায় ওই শিক্ষার্থীর নামেই প্রতিষ্ঠানের মুখ উজ্জ্বল হতো। ফলে নতুন করে তালিকা প্রণয়নের কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। আর এখন সেরা স্কুলের তালিকা প্রকাশ করায় স্কুলগুলো অসুস্থ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। তা মোটেই কাম্য নয়।
মাধ্যমিক এবং সমমানের ফলাফল প্রকাশের ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আগামীবার থেকে সেরা স্কুলের তালিকা না প্রকাশের ঘোষণা দেন। আর এমসিকিউ থাকবে কিনা তা বিবেচনা করছেন বলে জানান। আর গত রোববার শিক্ষাসচিব এমসিকিউ প্রসঙ্গে বলেন, আগামীবার থেকে এমিসিকিউ থাকবে কিনা সবার মতামত নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দেশের শিক্ষার দুই অধিকর্তার মন্তব্যের পরে বিষয়গুলি নিয়ে শিক্ষাঙ্গনে আলোচনা-বিশ্লেষন চলছে।