চট্টগ্রামে ‘বাঙ্গালি খান সাহেব’ নামে ডাকা হতো কুখ্যাত আলবদর নেতা মীর কাশেম আলীকে। মীর কাসেমের পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায়। তবে বাবার চাকরির সূত্রে তিনি ছোটবেলা থেকে চট্টগ্রামে থাকতেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্রশিবির) চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি ছিলেন। ৭ নভেম্বর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন।
একাত্তরে তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে নৃশংসতা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো আলবদর ও আল শামস বাহিনী। চট্টগ্রামের কুখ্যাত ডালিম হোটেলে স্থাপিত বিভীষিকাময় নির্যাতন কেন্দ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ছিল মীর কাশেম আলীর।
ওই সময় মীর কাশেম চট্টগ্রাম শহর শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি, আলবদর বাহিনীর নেতা ও নির্দেশদাতা ছিলেন। নির্যাতন ও নির্মমতার মাত্রা এতটাই ছিলো যে, তাকে ‘বাংলার খান সাহেব’ হিসেবেও অনেকে উল্লেখ করেছেন। ওই নির্যাতন ক্যাম্পে যারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, সবকিছুর পেছনেই মীর কাশেম মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে অভিযোগ দায়ের, দোষী সাব্যস্তকরণ ও শাস্তি— তিনটি অংশেই ডালিম হোটেলে নির্যাতনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। নির্যাতনের আটটি অভিযোগে মীর কাশেম দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যার প্রতিটিতে কারাদণ্ড সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাকি যে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, এই দু’টিতেও ডালিম হোটেলে নির্যাতনের বিষয়টি ছিলো।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যে দেখা যায়, একাত্তরের ৮ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী চাক্তাই সাম্পান ঘাট থেকে মো. ওমর-উল-ইসলাম চৌধুরীকে অপহরণ করে। তাকে কোতোয়ালি থানাধীন দোস্ত মোহম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ে চামড়ার গুদামে টর্চার সেলে এবং পরে পাঁচলাইশ থানাধীন আসাদগঞ্জের সালমা মঞ্জিলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।
পরবর্তীতে ১২ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে একটি গাড়িতে করে তাকে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জোর করে সাদা কাগজে সই নিয়ে তার মামার কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ নভেম্বর দুপুর ২টার দিকে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনী লুতফর রহমান ফারুক ও সিরাজকে চাক্তাই এলাকার বকশিরহাটে জনৈক সৈয়দের বাড়ি থেকে অপহরণ করে। এরপর তাদের আন্দরকিল্লার মহামায়া হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়, যা সে সময় ডালিম হোটেল টর্চার সেল নামে পরিচিত ছিলো এবং মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।
পরে লুতফর রহমান ফারুককে বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের কর্মীদের বাড়িগুলো চিহ্নিত করিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ফারুককে আরো দুই-তিনদিন ডালিম হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে সার্কিট হাউজে নিয়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয় আলবদর। সেখানেও তার উপর নির্যাতন চালানো হয় এবং পরে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর সেখান থেকে ছাড়া পান ফারুক।
২২ অথবা ২৩ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ডবলমুরিং থানাধীন কদমতলীতে তার বাসা থেকে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা। তাকে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে মীর কাসেমের উপস্থিতিতে নির্যাতন চালানো হয়। দেশ স্বাধীন হলে ১৬ ডিসেম্বর সকালে ডালিম হোটেল থেকে জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে তার আত্মীয় ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন।
২৪ নভেম্বর গভীর রাতে মীর কাশেম আলীর উপস্থিতিতে ডবলমুরিং থানাধীন আজিজ কলোনি থেকে সাইফুদ্দিন খানকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে অন্যদের সঙ্গে তাকেও মারধর করা হয়। ডিসেম্বরের ২ অথবা ৩ তারিখে বন্দিদের চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়, সেখানে জেলারের মাধ্যমে সাইফুদ্দিনের স্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করেন। স্বামীকে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। ১৬ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পান সাইফুদ্দিন।
২৫ নভেম্বর দুপুর আড়াইটার দিকে মীর কাশেম আলীর নির্দেশে রাজাকার কমান্ডার জালাল চৌধুরী ওরফে জালাল জল্লাল নন্দন কানন এলাকার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সামনে থেকে আব্দুল জব্বার মেম্বারকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ১৭/১৮ দিন আটকে রেখে হাত ও চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের সময় পানি খেতে চাইলে তাকে প্রসাব খেতে দেয়া হয়, এর ফলে তিনি অন্য খাবার খেতে পারতেন না। ১৩ ডিসেম্বর মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
নভেম্বরের ২৮ তরিখ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মীর কাশেমের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তায় আলবদর সদস্যরা হারুন-অর-রশিদকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে চোখ ও হাত বেঁধে তাকে নির্যাতন করা হয়। পরে মীর কাশেমের নির্দেশে তাকে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থাতেই পাঁচলাইশের সালমা মঞ্জিলে আরেকটি নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর সালমা মঞ্জিল থেকেই তাকে উদ্ধার করা হয়।
একাত্তরের ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পরে মীর কাসেমের নির্দেশে ডবলমুরিং থানাধীন ১১১ উত্তর নলাপাড়া থেকে মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও ইলিয়াসকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেখানে তাদের আটকে রেখে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। মীর কাশেমের নিয়ন্ত্রণে থাকা এ নির্যাতন কেন্দ্রে আটক থাকার সময় তারা আরো অনেককে আটক অবস্থায় দেখতে পান। এদের অনেককে আবার ডালিম হোটেল থেকে নিয়ে যেতে দেখেন তারা, এবং পরে শুনতে পান যে বদর বাহিনীর সদস্যরা তাদের মেরে ফেলেছে।
পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য সরবরাহ করার শর্তে মীর কাশেমের নির্দেশে ৬ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান এবং ৯ ডিসেম্বর মো. সানাউল্লাহ চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
২৯ নভেম্বর রাত আড়াইটার দিকে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা চাঁদগাঁও থানাধীন সাবহানঘাটা মহল্লা ঘেরাও করে নুরুল কুদ্দুস, মো নাসির, নুরুল হাসেমসহ আরো কয়েকজনকে অপহরণ করে এনএমসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে যায়। পরে ভোরবেলায় ওই তিনজনসহ আরো অনেককে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনজনকে দশদিন আটক রেখে নির্যাতন করা হয় এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ১৬ ডিসেম্বর তারা ছাড়া পান।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ২৯ নভেম্বর ভোরে মীর কাশেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে চাঁদগাঁও থানাধীন নাজিরবাড়ি এলাকা থেকে পাঁচ চাচাতো ভাইসহ নুরুজ্জামানকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। সেখানে তাদের আটকে রেখে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরে তাদেরকে সেখান থেকে মুক্ত করা হয়।
একই সময়ে মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা নাজিরবাড়ি এলাকা ঘেরাও করে মো. জাকারিয়া, মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়া, ইস্কান্দর আলম চৌধুরী, মো. নাজিম উদ্দিনসহ আরো অনেককে অপহরণ করে এবং এনএমসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে যায়। পরে তাদের সবাইকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। বয়সে ছোট হওয়ায় নাজিমুদ্দিনকে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হয়।
সাত-আটদিন পর মো. জাকারিয়াকে, ১১ অথবা ১২ ডিসেম্বর মো. সালাউদ্দিন ওরফে ছুট্টু মিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবশেষে ইস্কান্দর আলম চৌধুরী ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া পান।
১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাশেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের কোনো একদিন মীর কাশেম আলীর পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা হিন্দু অধ্যুষিত হাজারি লেনের ১৩৯ নম্বর বাড়ি থেকে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং ১১৪ নম্বর বাড়ি থেকে রঞ্জিত দাস ওরফে লাঠুকে ও টুনটু সেন ওরফে রাজুকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। পরদিন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ছেড়ে দেওয়া হলেও লাঠু ও রাজুকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়।
এই তিনজনকে অপহরণের সময় আলবদর বাহিনী এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেক দোকানপাট লুট করে এবং অন্তত আড়াইশ’ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এর ফলে অন্তত একশ’ হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।
নভেম্বরের কোনো একদিন আন্দরকিল্লার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার গোলাম মোস্তফা কাঞ্চনের বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে ফিরছিলেন সুনীল কান্তি বর্ধন ওরফে দুলাল ও তার স্ত্রী, ছেলে ও একজন কিশোর গৃহকর্মী। পথে চাক্তাই সাম্পানঘাটে পৌঁছালে মীর কাশেমের নির্দেশে দুলালকে অপহরণ করে চাক্তাইয়ের দোস্ত মোহম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো অনেক সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় দুলালকে। পরে ১৪ ডিসেম্বর তাদের সবাইকে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে দুলালকে উদ্ধার করা হয়।
নভেম্বর মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানধীন নাজির আহমেদ চৌধুরী রোডে এ জে এম নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। একদিন গভীর রাতে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে কয়েকজন আলবদর সদস্য ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে। তারা নাসিরুদ্দীন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় এবং সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। ১৬ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকে আরো এক-দেড়শ’ লোকের সঙ্গে নাসিরুদ্দিনকেও উদ্ধার স্থানীয়রা।