আমার দেশ, আমার পৃথিবী কি শান্ত হবে না আর? আমরা কী আর ফিরে পাবো না-‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’ কাল? আমরা কী আর কখনো হতে পারবো না ‘বৃক্ষস্বভাবী’ সহনশীল? আমরা কি বুক চিতিয়ে আর বলতে পারবো না-‘পৃথিবী মানবের; দানবের নয়’।
১. ফেনীতে নুসরাত নামে এক মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে মারলো কিছু ‘মানুষ’। এই হত্যাকাণ্ড- প্রমাণ দিলো নদীমাতৃক, বৃক্ষমাতৃক এই বাংলাদেশে আমরা এখনো কত নিষ্ঠুর, অনেক অনেক হিংসা, প্রতিহিংসা জমে আছে আমাদের ভেতর। মাদ্রাসা অধ্যক্ষের হুকুমে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা, স্কুলের প্রধান শিক্ষকের হাতে ১১ বছরের শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হওয়া, স্বামীকে জিম্মি করে স্ত্রীকে পালাক্রমে নির্যাতন করা, প্রেমিককে বেঁধে রেখে তার সামনেই প্রেমিকাকে যৌন নিপীড়ন করা, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও শিশু ধর্ষণের ঘটনা আমাদের অস্থির করে তোলে! আমরা যারা এই সমাজে সংঘবদ্ধ নই, নিতান্তই আটপৌঢ়ে জীবন-যাপন, তাদের বুক কেঁপে ওঠে।
২. দেশের এমন নিষ্ঠুরকালে, দুনিয়াও কেঁপে উঠছে বার বার। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলা। প্রাণগেলো কতগুলো নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষের। সেই ক্ষত, বেদনা শেষ হতে না হতেই শ্রীলঙ্কার রাজধানীতে, ইস্টার সান ডে তে ঘটলো আরেক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। গির্জা, অভিজাত হোটেলে একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হলো অন্তত ২৯০ মানুষকে। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরো ৫০০ মানুষ। আমাদের খুবই নিরীহ প্রশ্ন, যেভাবে, যে দেশেই এসব নিষ্ঠুরতা চালানো হোক না কেনো, মরছেতো মানুষই। আর ধর্মের আধিপত্যের নামে, ক্ষমতা বিস্তারের নামে, বাণিজ্য প্রসারের নামে, অস্ত্র বিক্রির নামে যদি মানুষই মেরে ফেরতে হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত থাকবেটা কী?
কলম্বোর এই হামলা এমনিতেই নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে আমাদের ওপর। তারওপর যখন শিশু জায়ানের প্রাণবন্ত ছবিটা ভাসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন বুকের ভেতর ভীষণ বেদনার খোঁচা দিচ্ছে অনেক প্রশ্ন। দেশে-বিদেশে অভিজাত হোটেলগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকে। সেই নিরাপদ জায়গায়, বাবার হাত ধরে জায়ান সকালের খাবারের জন্য নেমেছিলো। নামার আগে হোটেলের কক্ষে নিশ্চয়ই মায়ের গলা ধরে আদর নিয়ে এবং দিয়ে এসেছে সে। তারপর এই ঘটনা। হঠাৎ বোমার আঘাত। প্রথমে ছোট্ট এই মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। পরে হাসপাতালে মিলেছে তার নিথর-প্রাণহারা দেহ। ওই হামলায় জায়ানের বাবা গুরুতর আহত হয়ে কলম্বোর একটি হাসপাতালে চিকিৎসীন।
মা-বাবা, ভাইয়ের সঙ্গে জায়ান বেড়াতে গিয়েছিলো সুন্দর-সমুদ্র দেশ, ভদ্রমানুষ, শিক্ষিত মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কায়। সেখানে এমন নিষ্ঠুর হামলা হবে কে জানতো? জায়ানের প্রাণতো কেড়েছে বর্বর মানুষের বোমা। জায়ানের বাবাকে করেছে আহত। আর জায়ানকে হারিয়ে তার মায়ের অবস্থা কেমন, কীভাবে কাটছে তার এক একটি মুহূর্ত; আমরা তা কেউ বুঝতে পারবো না; কোনো দিন। যার যায় কেমন সেই বুঝে হারানোর বেদনা! মা-বাবার বুক থেকে এভাবে শিশুদের কেড়ে নেয়া কতোটা কষ্ট, কতশত বেদনার জন্ম দেয় তা কোনোদিন বুঝতেই পারবে না ওই বোমাবাজ-হামলাকারীরা।
৩. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, যশোরে উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা, পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে বোমা হামলা আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। তারপর, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা নতুন করে বিপন্নতার মুখে ফেলে দেয় বাংলাদেশকে। সেই ধকল এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাদের। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা,
শ্রীলঙ্কায় গির্জা আর অভিজাত হোটেলে বোমা হামলা পুরো দুনিয়াকে ভাবিয়ে তুলছে। এই ভাবনার বাইরে নই আমরা। কম আয়তনের বাংলাদেশে বিপুল জনসংখ্যা। তারওপর পাশের দেশ থেকে বাঁচার আশায় পালিয়ে এসেছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে মানুষে ঠাসা এক দেশ। এখানে অনেক ধর্মের অনুসারী মানুষ আছে। আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা প্যাগোডা। এখানে ভালো মানুষ আছে অনেক অনেক। তবে মন্দজনও যে নেই তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। যদিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্তারা বলছেন, ‘সতর্ক অবস্থা’ রয়েছে সব সময়।
৪. বলি, তাই যেন হয়। এই দেশে, মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে কোনো অপশক্তি ধর্মের নামে, ক্ষমতা দখলের লোভে যেন কোনো রক্তপাতে মেতে না ওঠে। এইসব খুন, হানাহানি, ধর্ষণ, আগুনে পুড়িয়ে মারা কোনো শুভবুদ্ধির মানুষের আকাঙক্ষা হতে পারে না। এইসব যুদ্ধ, এই সব ধ্বংস শেষে মানুষ শান্তির পথেই হাঁটবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)