সাম্প্রতিক সময়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা অপসারণে বড়সড় অভিযান শুরু হয়েছে। বুড়িগঙ্গায় অভিযান চালাচ্ছে মূলত বিআইডব্লিউটিএ। তাদের অভিযানের তালিকায় তুরাগ নদের নামও আছে এবং ১৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেখানেও অভিযান সম্পন্ন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। আর চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে অভিযান চালাচ্ছে জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন।
তবে ঢাকায় বুড়িগঙ্গার অভিযানেও জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতা রয়েছে। তুরাগের অভিযানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন সহায়তা দেবে বিআইডব্লিউটিএকে। কারণ উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের তথা খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নদ-নদী দখলমুক্ত করার এই অভিযান চলছে।
নদী ও উন্মুক্ত জলাভূমিসহ প্রাকৃতিক পানিসম্পদ রক্ষায় উচ্চ আদালত ও সরকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলীতে চলমান উচ্ছেদ অভিযান ইতোমধ্যে পরিবেশবাদী ও প্রকৃতিপ্রেমীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তাই জনগণের প্রত্যাশা এমন অভিযান সারা দেশেই চলুক।
কিন্তু প্রশংসনীয় এই অভিযানের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি বিলীন হওয়া নদীর নাম বারবার আসছে। সেটি হলো টঙ্গী বা কওহরদরিয়া। রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে একসময়ে বৃত্তাকারে যে ৬টি নদ-নদী প্রবাহিত ছিল তার একটি হলো টঙ্গী বা কওহরদরিয়া। ইদানিং কেউ কেউ এমনকি অনেক গণমাধ্যমও কওহরদরিয়াকে তুরাগ নদের আরেকটি নাম হিসেবে প্রচার করে থাকে। আর এভাবেই মুছে যেতে চলেছে এবং প্রায় গেছেও সেই কওহরদরিয়া নদীর নাম।
২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে রাজধানী ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ খনন প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরির সময় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পূর কৌশল বিভাগ (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট) টঙ্গীর পাশাপাশি ধলেশ্বরী নদীর নামও বাদ দিয়েছিল। যদিও কালের বিবর্তনে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ও স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে টঙ্গী বা কওহরদরিয়া নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
কিন্তু প্রবহমান ধলেশ্বরীকে কীভাবে বৃত্তাকার নদীগুলোর তালিকা থেকে বাদ দিলো বিআইডব্লিউটিএ তা বোধগম্য নয়। প্রকল্প প্রস্তাবনায় চারটি নদীর নাম উল্লেখ করেছিল রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। সেগুলো হলো- বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা। এতোবড় ভুলের জন্য বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে আমি মনে করি।
প্রকৃত তথ্য হচ্ছে- রাজধানীর চারদিকের ৬টি নদ-নদীর মধ্যে বর্তমানে দৃশ্যমান আছে ৫টি। আর অদৃশ্যমান হলো টঙ্গী নদী, যার মূল নাম কওহরদরিয়া। কিন্তু কালের বিবর্তনে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নানা কারণে কওহরদরিয়া নদীটি গতিহারা হয়ে মারাত্মক সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। একইভাবে তুরাগ নদও হয়ে পড়ে মারাত্মক সংকুচিত। দুটি নদীর ক্ষেত্রেই এর মূল কারণগুলো ছিল দূষণ, ভরাট, ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর অদূরদর্শীতা ও উদাসীনতা। অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হওয়ার কারণে স্থানীয়দের কাছে কওহরদরিয়া বা টঙ্গী নদীটি একসময়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে টঙ্গী খাল হিসেবে পরিচিতি পায়।
তবে ধীরে ধীরে নদী দুটির আয়তন এতই কমে যায় যে, এক পর্যায়ে তুরাগ ও কওহরদরিয়া (টঙ্গী) দৃশ্যত একটি নদীতে রূপ নেয়। যদিও টঙ্গী বা কওহরদরিয়া একটি স্বতন্ত্র নদী। পরবর্তী সময়ে জনপ্রতিনিধিবৃন্দ ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সুদৃষ্টির অভাবে টঙ্গী বা কওহরদরিয়া নদী চলে যায় মানুষের দখলে। সেখানে (ঢাকার আশুলিয়া ও গাজীপুরের টঙ্গীর একাংশসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা) গড়ে ওঠে জনবসতি, শিল্পকারখানা, দোকানপাটসহ নানা ধরনের স্থাপনা। ভরাট হওয়া নদীটির অনেকস্থান রূপ নিয়েছে আবাদি জমিতে; যেখানে বছরজুড়ে কৃষিকাজও হচ্ছে। এককালে বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে প্রবহমান কওহরদরিয়ার বুক এখন রীতিমতো সমতল ভূমিতে রূপ নিয়েছে।
আহা! আমরা এভাবে একটি নদীকে গলাটিপে হত্যাই করলাম না, একেবারে নাম-নিশানাও মুছে ফেললাম তার। তা-ও আবার খোদ রাজধানীর পাশে। আর এভাবেই তো আমরা গত ছয় দশকে (১৯৬০-২০১৯) সারা দেশে বহু নদীর নাম-ঠিকানা মানচিত্র থেকে মুছে ফেলেছি; যা কিনা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার মতো। যে কারণে এক সময়ের ২৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথের দৈর্ঘ্য কমতে কমতে পাঁচ হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছিল। তবে বর্তমান সরকারের গত ১০ বছরের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
পরিবেশ-প্রকৃতি সচেতন সাধারণ মানুষ চায় দেশের সকল নদী ফিরে পাক যৌবন। সরকারও চায়, উচ্চ আদালতও তাই চেয়েছেন। তাহলে এখনই তো টঙ্গী বা কওহরদরিয়া নদীকে উদ্ধারের মোক্ষম সময়। ১৮৮৮-১৯৪০ সাল পর্যন্ত ক্যাডাস্টেরিয়াল সার্ভে (সিএস) ও ১৯২৫-১৯৩৩ সাল পর্যন্ত এস্টেট এ্যাকুইজিশন সার্ভের (এসএ) ম্যাপে নদীটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। সুতরাং টঙ্গী নদী উদ্ধার করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। এই নদী উদ্ধার হলে শিল্পসমৃদ্ধ গাজীপুর ও ঢাকার সংশ্লিষ্ট এলাকায় গড়ে উঠতে পারে নদীকেন্দ্রীক বিশাল পর্যটন কেন্দ্র। সেই সঙ্গে কৃষিতে সেচসুবিধা ও প্রাকৃতিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রও প্রসারিত হবে; সব মিলিয়ে যা জাতীয় অর্থনীতির চলমান চাকাকে গতিশীল করতে পারে। তাই নিশ্চিহ্ন টঙ্গী নদী উদ্ধার এখন সময়ের দাবি। আশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল জনস্বার্থমূলক বিষয়টির ওপর দ্রুত নজর দেবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)