শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া জীবন অচল। শিক্ষাই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যার কাছে সব শক্তিই অসহায়। তবে সেই শিক্ষা অবশ্যই সুশিক্ষা হতে হবে। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ। শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও উন্নয়ন। শিক্ষা ও সংস্কৃতি জাতি গঠনের মূল উপাদান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা। আর সেই শিক্ষার মূল চালিকা শক্তি অর্থাৎ মধ্যমণি হচ্ছে শিক্ষক সমাজ।
কবি কাদের নেওয়াজের ”ওস্তাদের কদর” কবিতা থেকে উদ্ধৃত দুটি লাইন “আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।” এই লাইন দুটিতে শিক্ষকের মর্যাদার কথাই প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সমাজে শিক্ষকদের সম্মান তো দূরের কথা বরং তারা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও আহত হচ্ছেন প্রতিনিয়তই। এমনকি বখাটের হাতে নির্মমভাবে আহত হয়ে মারা যাচ্ছেন। জাতি গড়ার কারিগর যারা, তারা এমনিভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। যে জাতি শিক্ষকের মর্যাদা দিতে জানে না, তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।
শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর ও শিক্ষা পরিজনের মূল নিয়ামক এবং সভ্যতার অভিভাবক। শিক্ষকরাই সভ্যতাকে লালন পালন করেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিক নির্দেশনাসহ মানসিক উন্নয়নে পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। এজন্য বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, ‘Teachers are the guardian of civilization’ শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক মূল্যবোধ শিখিয়ে থাকেন। তারা ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পথ দেখান।
মমতাময়ী শিক্ষকরাই তাদের মহৎ পেশা দিয়ে নতুন প্রজন্ম তথা জাতিকে সুশিক্ষিত করে অবিরত দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করে চলছেন। কোন দেশের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভর করে ঐ দেশের তরুন জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে শিক্ষাদানের মাধ্যমে, আর সেই কাজটি করে থাকেন নিবেদিত প্রান শিক্ষক সমাজ।
ছেলে মেয়েদের সুশিক্ষিত করতে বাবা মায়ের চেয়ে শিক্ষকের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। বিশ্বের সব সমাজেই ঐতিহ্যগতভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা অধিক। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেকটাই তারা করুণার পাত্র। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উপেক্ষিত। জাতি গঠনের এই মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যাদের পথ চলা, তারা আজ অবহেলিত, নির্যাতিত, চড়-থাপ্পড় খাওয়া, কান ধরে ওঠ-বস করা স্বল্প আয়ের শিক্ষক সমাজ।
ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের জন্য একটি শিক্ষিত ও মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মূল চালিকা শক্তি আজকের তরুন প্রজন্ম। দিন বদলের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হলো শিক্ষা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রথমেই প্রয়োজন ডিজিটাল মানের শিক্ষকের।
এই তরুন প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ ও মেধাবী মানব সম্পদ হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাদের? সমগ্র জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন রইল। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কাদের দিয়ে গড়বেন সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ? শিক্ষকরা যে পারিশ্রমিক বা সম্মানী পান, তার বিনিময়ে জাতিকে ফিরিয়ে দেন অনেক কিছুই। চরম দুর্দিনে দেশে যখন প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করে তখন গোটা জাতি দেশবরেণ্য, আদর্শবান ও রাজনৈতিক সচেতন শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
এখন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাজিস্ট্রেট ও আর্মি অফিসার হবার প্রবণতা দেখা যায় না। কারণ এসব পেশায় আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা কম বিধায় মেধাবীরা এই পেশা নির্বাচনে অনাগ্রহী। এখন তরুন প্রজন্মের অনেকের মুখ থেকে শোনা যায়, তারা আইনজীবি হতে চায়। কারণ পরবর্তীতে রাজনীতির মাধ্যমে মেম্বার অব পার্লামেন্ট হবেন, যা বর্তমানে অহরহ প্রতীয়মান। মেধাবীরা একারনে মনে হয় এই মহৎ পেশায় আসতে অনীহা প্রকাশ করছে। এভাবে চলতে থাকলে জাতি অন্ধকারে ধাবিত হতে বাধ্য।
সকল বিচারেই শিক্ষকতা একটি মহান পেশা এবং অন্যান্য পেশা থেকে আলাদা। যদি তাই হয়, তবে জাতি গঠনের এই মহান দায়িত্ব কাঁধে বহনকারি শিক্ষকের গালে থাপ্পড় মারার, ইভটিজিং এর প্রতিবাদে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া, কান ধরে ওঠ-বস করানো এমনকি গায়ে হাত তোলা জাতি কখনই আশা করে না বা কাউকে এ অধিকার দিতে পারে না। একজন কলেজ শিক্ষক কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স পাশ, তা সবারই জানা। আপনারা অনেকেই পত্রিকায় পড়েছেন জনৈক এম.পি মহোদয় তার নির্বাচনী এলাকার এক কলেজের একজন সম্মানিত অধ্যক্ষকে প্রকাশ্যে পিটিয়েছেন। শিক্ষকের সংঙ্গে এমন ঘটনায় গোটা জাতি তথা শিক্ষক সমাজ আজ হতাশ, তবে বিস্মিত নয়। কি অবাক কর্মকান্ড?
বিবেকের রায় মানলেই আমরা মানুষ। দেশকে স্বাধীন ও মুক্ত করার জন্য যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিলেন, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তথা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক প্রতিফলন আজ কোথায়? কত বড় সাহস? সংখ্যালঘু হয়েও মুসলমান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষাগুরুকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে। গোটা বাঙ্গালী মুসলমান মুক্তিযুদ্ধ প্রেমিক একদিন জানতে চেয়েছিল শ্রীরূপমের শক্তির উৎস কোথায়? তাহলে কী ভাবতে পারি জিন্নাত স্যার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা না জামাতী মুক্তিযোদ্ধা? আসলে শ্রী রূপম কে? কী তার পরিচয়? ছাত্রীদের বুকফাটা কান্না, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ার মধ্য দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক জিন্নাত আলীর দাফন সম্পন্ন হয়েছিল।
সবই মেনে নিলাম, কিন্তু আমার ১৯৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ঢেলে স্বাধীন দেশে যে সোনার সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাকে মারল, সে কি রাজাকার না বাবু গয়েশ্বর এর উত্তরসূরি কৃষ্ণ চন্দ্রদের বখাটে পুত্র শ্রী রুপম? একেই কি বলে সংখ্যালঘু? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে আবারো প্রশ্ন রইল! একজন বাবা চলে গেলে, যিনি তার পরিবারের সবাইকে আগলে রেখেছিলেন, কিন্তু এখন কী হবে ওদের? থেমে গেল একটা উপার্জনক্ষম হাত। বিবেকবান জাতি আপনারা জানেন তারপর কি হবে এই পরিবারের? কে দেখবে তাদের? শ্রী রুপম বাবুর শাস্তি হবে, বড় জোর জেল না হয় ফাঁসি। তাতে শিক্ষক হত্যা কি কমবে? মৌলবাদরা যেভাবে হত্যা করেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রফেসর ইউনুস স্যার ও এস তাহের আহমেদ স্যার কে।
নাটোরের কলেজ শিক্ষক মিজান হত্যার খবর সবাই জানেন। মিজান শিক্ষকতার পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবে বিবেকের টানে ছাত্র ছাত্রীদের পাশে দাঁড়ান। নিজের জীবন দিয়ে প্রমান করেছিলেন শিক্ষকরা সমাজের তথা জাতির বিবেক। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও জান্নাত-জাহান্নাম সম্পর্কে কটুক্তি করায় নড়াইল সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নুপুর রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা উজির আহমেদ খান (সূত্র: ২৪ অক্টোবর ২০১১, বাংলাদেশ প্রতিদিন)।
কিন্তু এবার দেখলাম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উদাত্ত আহ্বানে সারা জাগরনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রাণনাশ। জিন্নাত স্যারকে আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন। আবার দেখলেন ! কিভাবে নৃশংস ভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর দুই জন স্যার প্রফেসর এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলন স্যার ও এ এফ এম রেজাউল করিম কে হত্যা করা হল।
মানুষ কিন্তু আব্দুর রহমান বদি এম.পি মহোদয়কেও চিনে ও জানে। সবশেষে নারায়ণগঞ্জে সাংসদ সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্দি ভক্তকে কান ধরানোর ঘটনায় দেশজুড়ে বইছে সমালোচনার ঝড়। হাজারো জনতার সামনে একজন শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করানো কি আদৌও সমীচিন হয়েছে?
সমগ্র শিক্ষক সমাজ তথা গোটা জাতি জননেত্রী শেখ হাসিনার দিকে অধীর আগ্রহে দেশের সমস্ত ভালো কাজের ফলাফলের জন্য তাকিয়ে থাকেন। এসবের সঠিক বিচার হলে তা হবে সারা বিশ্বের মডেল। থমকে যাবে সকল বখাটেরা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য সন্তান জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সুদক্ষ ও কঠোর বিবেচনা দ্বারা মানুষগড়ার কারিগরদের লাঞ্চনার প্রতিকার করবেন এটাই সমাজের সকল বিবেকবান মানুষের প্রাণের দাবি।
মেধাবীরা যাতে শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলা এখন সময়ের দাবী। সত্যিকারের একজন আদর্শ শিক্ষক নৈতিকতার মানদন্ডে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষও। শিক্ষকদের সৎ, আদর্শবান, নৈতিকতাসম্পন্ন, দায়িত্বশীল, আত্মমর্যাদাশীল, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা দরকার। তারা গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করবেন। এমন একদিন আসবে যেদিন জাতি শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে বাধ্য হবে। তার অপেক্ষায় গোটা শিক্ষক সমাজ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)