পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কবি জয় গোস্বামীর একটি ছোট বই ‘পাড়া ক্রিকেট, ক্রিকেট পাড়া’। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে আসেন। চ্যানেল টোয়েন্টিফোর কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকার স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল একটি ‘ওয়ান টু ওয়ান’ ইন্টারভিউয়ের জন্য। কিন্তু তিনি রাজি হননি। কারণ চট্টগ্রাম থেকেই কলকাতায় ফিরবেন। ফলে আমাকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে এবং সেখানে বসেই তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা। তাঁর ব্যক্তি ও লেখকজীবন, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবনা এমনকি মৃত্যুচিন্তা।
রেকর্ডিং শেষে হালকা কথাবার্তার একপর্যায়ে তিনি বিস্ময়করভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘আমীন, আপনি কি কখনো ক্রিকেট খেলতেন?’ জয় গোস্বামীর মতো একজন কবি ও প্রথিতযশা মানুষের কাছ থেকে এরকম অফট্র্যাকের প্রশ্ন শুনে প্রথমত ভিরমি খাই। বুঝে উঠতেই কিছুটা সময় লাগে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ‘জি, তা তো একটু-আধটু খেলতাম। তাছাড়া আমার শহরে সমবয়সীদের কাছে ভালো ব্যাটসম্যান হিসেবেও মোটামুটি সুনাম ছিল। কিন্তু আপনি এমন একটি প্রশ্ন কেন করলেন?’ জয় গোস্বামী শিশুসুলভ সরলতায় বললেন, ‘না…আপনার হাঁটার ধরন দেখে মনে হচ্ছে আপনি ক্রিকেট খেলতেন।’ তখন মনে হলো, একজন কবিকে যে আসলেই দূরদৃষ্টি এবং অন্তঃর্দৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়, জয় গোস্বামী বোধ করি সেটিই প্রমাণ করলেন।
তবে এটা ঠিক এবং আমি নিজেও এটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, সবার সবকিছু বলার কিংবা লেখার অধিকার থাকলেও আত্মনিয়ন্ত্রণটাও জরুরি। অর্থাৎ সবার কিছু বলা ও লেখার লাগামটা নিজের হাতেই থাকা দরকার। সৈয়দ শামসুল হক যেটি বহু আগেই সতর্ক করেছেন, ‘কী লিখবেন সেটি জরুরি, কী লিখবেন না সেটিও জরুরি।’ সে হিসেবে আমি মনেই করি, অন্তত ক্রিকেট নিয়ে আমার লেখার প্রয়োজন নেই। কারণ এই বিষয় নিয়ে লেখার মতো বোদ্ধা ও পণ্ডিত অনেক আছেন। তাছাড়া এই বিষয়ে আমি যা লিখব, সেখানে খুব বেশি নতুন কিছু থাকবে এমনটি ভাবারও কারণ নেই।
কিন্তু যেহেতু এখন বিশ্বকাপ চলছে এবং ঈদের রাতে নিউজিল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে হেরেছে এবং আর অল্প কিছু রান তাদের ঝুলিতে থাকলেই কিংবা মুশফিকের ‘অপ্রয়োজনীয়ভাবে’ আউট না হওয়া অথবা নিউজিল্যান্ডের একজন ব্যাটসম্যানকে বাগে পেয়েও রানআউটে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠাতে পারলে কিংবা শেষ মুহূর্তে একটি রিভিউ বাকি থাকলে আরেকজনের এলবিডাব্লিউ কনফার্ম করা গেলেই যে বাংলাদেশ জিতে যেতো, সেটি সম্ভবত পুরো দেশবাসীই বিশ্বাস করেন এবং এ কারণে নিশ্চয়ই এখন তাদের আক্ষেপও হচ্ছে।
তবে কথা হচ্ছে, এটাই ক্রিকেট। যখন নিউজিল্যান্ডের জেতার জন্য মাত্র ৬ রান লাগে তখন বলটি বাউন্ডারির বাইরে না গিয়ে যদি পরপর দুই বলে দুজনের উইকেট ভেঙে যেতো, সেটিও অসম্ভব ছিল না। বরং বাংলাদেশ এখন এসব অসম্ভবের জন্ম দেয়ার মতোই যোগ্য। এক দশক আগেও যে বাংলাদেশ শক্তিশালী কোনো দলের বিপরীতে দুইশো করলেও দেশবাসী খুশি হতো, এখন সেই বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের বিরুদ্ধে ৩৩০ রান করে এবং তাদের হারিয়ে দেয়। সেই বাংলাদেশ এখন ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয়।
সুতরাং বাংলাদেশ যেমন এখন আর হেনরি কিসিঞ্জারের সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, তেমনি ক্রিকেটেও বাংলাদেশ এখন আর দুইশো রানে সন্তুষ্ট থাকার দল তো নয়ই, বরং পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশকেও হারিয়ে দেয়ার মুরদ রাখে—এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
কিন্তু সেই বাস্তবতার ভেতরেও দুয়েকটা ছোট ছোট ঘাটতির কথা বলার জন্যই এই দীর্ঘ দোহাই।
১. এবারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বাংলাদেশ হারাতে পেরেছে মূলত রানের বড় টার্গেট দিতে পারায়। রান তিনশো বা এর কিছু কম হলেই জয়টা অনেক বেশি কঠিন হতো। তার মানে প্রথম বিজয়ের নায়ক প্রধানত ব্যাটসম্যানরা (কাউকে ছোট করছি না)। দ্বিতীয় খেলায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রান আড়াইশোর ঘরে গেল না কারণ তামিম-সৌম্য যেভাবে শুরু করেছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় সাকিব ছাড়া কেউই জ্বলে উঠতে পারেননি। এমনকি ‘মিস্টার ডিপেনড্যাবল’ মাহমুদুল্লাহও যে শট খেলে আউট হয়েছেন, সেটি তার স্টাইল ও ক্যারেক্টারের সঙ্গে যায় না। মুশফিকের আউটটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। শেষদিকে বরং বোলার সাইফুদ্দিনই কিছুটা লড়াই করলেন, যেটি তিনি না করলেও তাকে দোষোরোপ করা যেত না। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মাশরাফী প্রধানত বোলার হলেও ব্যাট হাতে তাঁর ছক্কা হাঁকানোর যে অভ্যাস, সেটিও এ দফায় আলোর মুখ দেখেনি। তার মানে কি এই যে, নিউজিল্যান্ডে সাথে লড়াই করে হেরে যাওয়ার পেছনে মূলত দায়টা ব্যাটসম্যানদেরই? ভিন্নমতও থাকতে পারে।
নিজেকে ক্রিকেট বিষয়ে একজন ‘নির্বোধ’ স্বীকার করে নিয়েই বলি, অনেক সময়ই মনে হয় আমাদের ব্যাটসম্যানরা ইমোশনাল শট খেলেন। ক্রিকেট ইমোশনের খেলা তাতে সন্দেহ নেই। কারণ প্রতিটি বল ও প্রতিটি শটের সময় পুরো দেশবাসী স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে। ক্রিকেট এখন রাজনীতি ও নানা কারণে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার একমাত্র প্লাটফর্ম।
সুতরাং কোটি টাকার বিজনেসের পাশাপাশি এখানে আবেগ থাকবে, দেশপ্রেম থাকবে সেটিই বরং স্বাভাবিক। কিন্তু লড়াইটা যখন ব্যাটবলের, তখন সেখানে যুক্তি ও অঙ্কটা আরও বেশি জরুরি। কারণ একটি ভুল অঙ্ক কিংবা অতি আবেগী শট উইকেট ভেঙে দিতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে দেশপ্রেম ও আবেগের বাস্তবতা মাথায় রেখে আমার মনে হয় ব্যাটসম্যানদের আরও বেশি লজিক্যাল ও গাণিতিক হওয়ার প্রয়োজন আছে।
২. আমাদের বোলিং লাইনআপ নিশ্চয়ই খারাপ নয়। কিন্তু এখনও আপ টু দ্য মার্ক কি? আমাদের স্পিন লাইন আপ (সাকিব, মিরাজ, মোসাদ্দেক) যেকোনো দলের চেয়ে শক্তিশালী হলেও ফাস্ট বোলিংয়ে ঘাটতির কথা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। আমাদের মাশরাফী, মোস্তাফিজ ও সাইফুদ্দিনরা নিশ্চয়ই অনেক ভালো বোলার। কিন্তু উইন্ডিজের শেলডন কটরেল, নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদি অথবা অস্ট্রেলিয়ার মিশেল স্টার্কের মতো ফাস্ট বোলার আমাদের কোথায়? বলের কারুকাজ সেই সঙ্গে গতি—এ দুইয়ের মিশেলে আমাদের কি এখনও ঘাটতি নেই? আমাদের সৌভাগ্য যে, বোলিং কোচ হিসেবে আছেন কোর্টনি ওয়ালশের মতো এমন একজন কিংবদন্তি—যিনি একসময় পৃথিবীর যেকোনো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের জন্য আতঙ্ক ছিলেন। তিনি এবং তার সতীর্থ কার্টলি অ্যামব্রোজ দুজন দুদিন থেকে বল স্টার্ট করতেন এবং দেখা যেতো ব্যাটসম্যানদের ঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে এমন দুর্দান্ত বোলিং জুটি আর কবে ছিল বা এরপরে আর হয়ছে কি না সন্দেহ। সেই ওয়ালশ এখন বাংলাদেশের ফাস্ট বোলিং কোচ। সুতরাং তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের বোলিং লাইনআপটি আরও বেশি চৌকস এবং ক্ষুরধার করা।
বাংলাদেশ টিমের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা শক্তিশালী টিমওয়ার্ক এবং মাশরাফীর মতো অধিনায়ক। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসা ও প্রার্থনাও একটি বিশাল শক্তি। ইংল্যান্ডের গ্যালারিতেও যে পরিমাণ বাংলাদেশি ও বাঙালির উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তা অন্য নয়টি ক্রিকেট টিমের জন্যই ঈর্ষার। লোকজন কাজ ফেলে এই যে গ্যালারিতে ছুটে আসে, অফিস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা দেখার জন্য এখানে-ওখানে বসে পড়ে, আমার পরিবারেই অনেক নারীকে চিনি যারা বাংলাদেশের খেলার দিন জায়নামাজে বসে নিজের দেশের জয়ের জন্য প্রার্থনা করেন, এমন একটি পরিস্থিতি যে তৈরি হলো, তার পেছনে আছে আবেগ, ভালোবাসা এবং অতি অবশ্যই দেশপ্রেম। সুতরাং মাঠে যখন মাশরাফিরা জিতে যায়, তখন জিতে যায় পুরো দেশ। তখন মাশরাফিদের ওই ১১জনের আনন্দের অশ্রু আবেগাপ্লুত করে ১৬ কোটি মানুষকে। সেইসাথে দেশের বাইরে থাকা আরও কোটিখানেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে। যারা এই একটিমাত্র ইস্যুতে কোনোরকমের মতভিন্নতা বা মতদ্বৈততার প্রকাশ ঘটান না। ফলে ক্রিকেট এখন আর কেবল হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্যই নয়; এটি এখন ১৬ কোটি মানুষের আবেগেরও বিষয়।
ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের এই আবেগের আরেকটি বড় কারণ বোধ হয় আমাদের নস্টালজিয়া। বিশেষ করে যারা শৈশব-কৈশরে গ্রাম ও মফস্বলে ভাঙাচোরা ব্যাট আর স্কচটেপ লাগানো বল নিয়ে উন্মাদনায় মেতে ছিল, তাদের জন্য তো বটেই। জয় গোস্বামীর সেই বই থেকেই একটু ঊদ্ধৃত করি: ‘সেইসব মাঠ আর জীবনে ফিরে আসে না, যা শৈশব কৈশোরে ছিল। খেলোয়াড়দের জীবনে হয়তো আসে, কিন্তু সবাই তো আর খেলোয়াড় হয় না। যারা হয় না তাদের কেউ কেউ চোখ বন্ধ করলে এখনও মনে মনে দেখতে পায়, ঘন সবুজ একটা ঘাসজমি, যার শেষে সাদা রঙের ছোট একটা ক্লাবঘর, নতুন চুনকাম করা। আর সেই ঘরের বাইরের দেওয়ালে একটা ব্ল্যাকবোর্ড টাঙানো, যার ওপর সাদা চকখড়ির দাগে সংখ্যা লেখা। রান-সংখ্যা, উইকেট-সংখ্যা।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)