নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবীর কথা আমরা সকলেই বলে থাকি, প্রত্যাশা করি এবং তৎসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নানামুখী উদ্যোগ, কনভেনশন, কনফারেন্স ও চুক্তি গৃহীত হয়। কিন্তু শান্তির স্বপক্ষে খুব ভাল ফলাফল আমরা পাচ্ছি না। পাবো কিভাবে, যারা অশান্তির মূল কলকাঠি নাড়ে তারাই যদি উদ্যোগ গ্রহণকারী হয় তাহলে সুখকর ফলাফল আসবে না সহজেই। যে দেশগুলো অস্ত্র ব্যবসার সাথে জড়িত এবং যাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সর্বোত্তম খাত হচ্ছে অস্ত্র ব্যবসা তারা স্বভাবতই চাইবে পৃথিবীতে সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগে থাকুক। যদি অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান থাকে তাহলে তারা বিবাদমান ইস্যুতে জড়িত উভয় পক্ষের কাছে গোপনে অস্ত্র বিক্রি করতে সক্ষম হবে। আমার অভিব্যক্তি হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে যারা মূল হোতা হিসেবে কাজ করে তারাই যদি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সন্ত্রাসবাদ/জঙ্গিবাদ দমনের জন্য মূল উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করে তাহলে নিরাপদ বিশ্ব প্রত্যয়টি অমূলক থেকেই যাবে। তাই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে বাকি বিশ্ব একজোট হয়ে শান্তির স্বপক্ষে কাজ করতে পারলে নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবীর অনুসন্ধান করা অমূলক কিছু হবে না।
দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। আমি, আপনি কিংবা আমরা কেউই সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকির বাইরে নয়। সন্ত্রাসবাদের বিষবাষ্প থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি এর সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন এজেন্সি ও গ্রুপকে সনাক্তকরণ সাপেক্ষে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আবার কিছু কিছু সমস্যা সম্বন্ধে আমরা অবগত হওয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থা না দেওয়ার ফলে সন্ত্রাসবাদের প্রকোপ কমছে না কিছুতেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের অস্ত্রের যোগানদাতা কারা? বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এবং বিশেষ করে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তাদের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। তারা হয়তো নিজেদের মতো করে কিছু অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম কিন্তু সেগুলো খুব বিপদজনক হওয়ার কথা নয়। কাজেই, যে সব দেশ অস্ত্র বিদেশে রপ্তানি করে তাদের মধ্য থেকেই কোন না কোন রাষ্ট্র সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের নিকট অস্ত্র বিক্রি করে থাকে। সে সব দেশকে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব এবং বৈশ্বিক বাজারব্যবস্থায় তাদেরকে একঘরে করে তাদের সাথে অন্যান্য সকল দেশের পারস্পারিক সকল সম্পর্ক ছেদ করা উচিত। সম্পর্ক ছেদ করা হলে তারা নিজেরা নিজেদের প্রয়োজনে সন্ত্রাসীদের সাথে সম্পর্ক (অস্ত্র ক্রয় বিক্রয়) বিকিয়ে দিয়ে নিরাপদ বিশ্বের ব্যানারে সামিল হবে।
তদুপরি, কিছুটা হলেও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে, কেননা অস্ত্র এবং গোলাবারুদের সংযুক্ততায় সন্ত্রাসীরা তাদের কর্মপরিধিকে বেগবান করে থাকে। অস্ত্রের যোগান বন্ধ হয়ে গেলে তাদের সক্ষমতা এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতা দিনে দিনে কমে আসবে। অন্যদিকে বলা যায়, সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের পেছনে নির্দিষ্ট সংখ্যক গোষ্ঠী এবং গ্রুপ আর্থিক সহায়তা করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং বসবাসের জন্য অনিরাপদ করতে বদ্ধপরিকর। সেসকল গ্রুপ, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তি পর্যায়ের যোগানদাতা ও উৎস ইতোমধ্যে ভিন্নধর্মী গবেষণা ও রিপোর্টের মাধ্যমে উঠে এসেছে। তাছাড়া প্রয়োজন সাপেক্ষে অধিক গবেষণা পরিচালনা করে আর্থিক যোগানদাতাদের চিহ্নিত করে সমূলে নিপাট করতে হবে। তবেই না সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি এবং সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ন কমে আসবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আর্থিক যোগানদাতারা খুবই শক্তিশালী থাকে এবং প্রচলিত আইন কানুন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার সক্ষমতা রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মিডিয়ার অনুসন্ধানে সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপকে চিহ্নিত করা গেলেও প্রচলিত আইন কানুনের মাধ্যমে কোন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি (হয়তো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্ব-উদ্যোগে কেউ মামলা করেনি কিংবা মামলা করলে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি)। সময়ই হয়তো সব কিছুর উত্তর দিবে, তবে নিরাপদ পৃথিবীর স্বার্থে এদেরকে নিঃশেষ করার জন্য যথাযথ উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দুটো সন্ত্রাসী হামলা বিশ্ব বিবেককে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির অব্যবহিত পরেই শ্রীলংকায় ন্যক্কারজনক ঘটনাটি অনিরাপদ বিশ্বকেই নির্দেশ করছে। আসলে কি ঘটছে পৃথিবীতে? মানুষ কি ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিরাপদ নয়-নিরাপদে ধর্ম পালন করতে পারবে না! তাই তো ঘটতে যাচ্ছে ক্রমশই। নিউজিল্যান্ড এবং শ্রীলংকায় ঘটে যাওয়া জঘন্য ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে মসজিদ এবং চার্চে। আর যারা হামলাটি চালিয়েছে তাদের কি কোন ধর্ম নেই? তারা কি ধর্মের অনুসারী নয়? অবশ্যই তাদের ধর্ম রয়েছে এবং চিরায়তভাবে অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু তারা যাদেরকে অনুসরণ করে কিংবা যাদের সহায়তায় কিংবা আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে এবং প্ররোচনায় উৎসাহী হয়ে হামলা পরিচালনা করে থাকে তাদেরকে খুঁজে বের করা উচিত। তবে সঙ্গত কারণেই বলা যায়, একটি মানুষ যখন সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে তখন তার কোন ধর্ম নাই, রাষ্ট্র নাই। বিবেকবর্জিত এবং মনুষ্য বিকৃতি করে জঘন্য কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার মানসিকতা তাড়িয়ে বেড়ায় সন্ত্রাসীকে। কারণ, মননে এবং মগজে মিথ্যার কষাঘাতে সামান্য ত্যাগের বিনিময়ে অসামান্য সাফল্য অর্জনের পায়তারা প্রোথিত থাকে সন্ত্রাসীদের এবং তাঁদের পথনির্দেশকগণ সেভাবেই পরিচালনা করে থাকে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের।
শ্রীলংকার হামলায় শেষ খবরে জানা যায়, প্রায় তিন শতাধিক (৩০০ জন) মানুষ নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে প্রায় ৫০০ মানুষ। হামলার পর শ্রীলংকান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে। শ্রীলংকান প্রধানমন্ত্রী রানিল বিকরেমাসিঙ্গে জানিয়েছেন, হামলাকারীরা শ্রীলংকান। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলার সাথে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর বাইরে শ্রীলংকান কর্তৃপক্ষ জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশজুড়ে কারফিউ দিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কর্তৃপক্ষ যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। অথচ, আমাদের দেশে কোন বিশেষ ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা দেওয়া হলে বিষয়টা সহজে মেনে নিতে পারি না।
শ্রীলংকায় বর্তমান যে হামলাটি হয়েছে তা যে একেবার হুট করেই হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। দেশটির পুলিশ প্রধান কয়েকদিন আগে যে কোন সময় হামলার শঙ্কার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন এবং সে সংক্রান্ত একটি বার্তাও কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল। একবার চিন্তা করা যায়, বার্তা থাকা সত্ত্বেও শ্রীলংকান কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীদের হামলা মোকাবেলা করতে পারেনি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, শ্রীলংকাতে বিদ্যমান সন্ত্রাসীদের কর্মকৌশল, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ আধুনিক হওয়ায় সঙ্গত কারণেই সন্ত্রাসীরা হামলা চালাতে সমর্থ হয়েছে। শ্রীলংকায় দীর্ঘদিন ধরে অনেকগুলো সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে এবং তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল: এলটিটিই, পিএলওটিই, টিইএলঅ, ইপিআরএলএফ, ইআরওএস, টিইএ, টিইএলএ, টিইএলই, টিই, আইএফটিএ, টিইডিএফ, টিইএনএ, টিপিএসও, টিপি, এসএফ, টিইসি, টিইএলএফ সহ সর্বমোট ৩৮টি সংগঠন দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকায় বিভিন্ন সময়ে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি জানান দিতে সক্ষম হয়েছে এবং কিছু হামলার দায়ভারও তারা নিজেদের কাঁধে নিয়েছে।
এখনো যেহেতু ঘটনাটির সুরাহা হয়নি, অর্থাৎ কেন এবং কারা এ হামলাটি ঘটিয়েছে তা জানা যায়নি, তাই নিশ্চিত হয়ে কাউকে দোষারোপ করা যাচ্ছে না। কিন্তু শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন ঘটনাটি শ্রীলংকানরাই ঘটিয়েছে। তার মানে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, শ্রীলংকাতে বিদ্যমান যে কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরাই এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এর সাথে দেশীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট জড়িত থাকতে পারে এবং সেটি তদন্ত সাপেক্ষে বেরিয়ে আসবে। আমরা আশা রাখবো, তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের (যারা ঘটনাটির সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত) উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে সন্ত্রাসীদের মনে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে যার সাপেক্ষে পরবর্তীতে কেউ এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সাহস না দেখায়।
ভবিষ্যতে যেন শ্রীলংকায় এমন ঘৃণিত হামলা না হয় তার জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। বিদ্যমান সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সাথে আলোচনা করে তাদেরকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত করে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দিতে পারে সরকার। অবশ্যই বিষয়টা যেভাবে বলছি ততটা সহজ নয়, সহজ হলে বিশ্বে খুব বেশি পরিমাণে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটতো না। সরকার সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ প্রদান করতে পারে এবং এ সুযোগ কিছু সংখ্যক হলেও গ্রহণ করবে এবং পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে প্রদানকৃত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সন্ত্রাসীদের বৈশ্বিক যোগাযোগ, ইন্ধনদাতা, আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী সহ অন্যান্য যাবতীয় তথ্য জেনে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক জোটের সহায়তা নিয়ে শ্রীলংকা থেকে চিরতরে সন্ত্রাসীদের নির্মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)