সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কার্যকর ভ্যালু চেইন গড়ে তুলতে সরকারী সহায়তা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খ্যদ্য নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন)।
কৃষিবিদ মিলনায়তনে প্রায় ২০০ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী নিরাপদ খাদ্য সম্মেলন থেকে এই আহ্বান করা হয়।
সম্মেলন শেষে গৃহীত ঘোষণায় দাবী জানিয়ে বলা হয়, নিরাপদ খাদ্যচক্র নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে সর্বক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। ‘খাদ্যমান মনিটরিং’ ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ‘কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ’ গড়ে তুলতে হবে। নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন বৃদ্ধির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে এগিয়ে আসার জন্য সম্মেলনের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের খাবারকে এমন একটা মানে নিয়ে যেতে হবে যাতে করে উন্নত দেশে রপ্তানী ক্ষেত্রে কোন বাধা না থাকে।
সম্মেলনে বলা হয়: নিরাপদ খাদ্য সবার অধিকার, এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সম্মেলনে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির নানা দিক, বিভিন্ন চালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে ‘নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন’ বিষয়ে সম্মেলনে বেশি আলোচনা হয়েছে।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের নিরাপদ খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আগামী বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছে জনগণের যে বিরাট প্রত্যাশা সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে কর্তৃপক্ষের জনবল কাঠামো বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
নেটওয়ার্কের সভাপতি মহিদুল হক খান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই খাদ্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদদারা, এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক এবং জাতীয় সংসদের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ (এপিপিজি’স) এর সেক্রেটারী জেনারেল শিশির শীল।
আয়োজিত নিরাপদ খাদ্য সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উপস্থাপিত হয়। সম্মেলনে বিএফএসএনএর কার্যক্রম তুলে ধরেন ক্যাব কর্মকর্তা আহমেদ একরামুল্লাহ, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করণে সামাজিক সচেতনতা শীর্ষক বক্তব্য রাখেন উবিনীগ এর পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জনি।
সম্মেলনে বক্তারা বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা নিঃসন্দেহে খাদ্যে নানা ভাবে ভেজাল দিচ্ছে। পাশাপাশি নানা ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের ফলে আমাদের মাটি, পানি ও বাতাস দূষিত হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পতিত হয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তিগত সচেতনতা ও হাইজিন/পরিচ্ছন্নতা মেনে না চলার কারণেও খাদ্য অনিরাপদ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। খাদ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রায় ২৫ লক্ষ ব্যক্তি ও ১৮ টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক বড় এক চ্যালেঞ্জ। সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা আমাদের সাংবিধানিক অধিকারের সাথে সম্পর্কিত।
‘নিরাপদ খাদ্য প্রসারে গণমাধ্যম: আরও কি করা যায়’ শীর্ষক বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী রানা। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনে কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন শিসউক এর নির্বাহী পরিচালক শাকি উল মিল্লাত মোর্শেদ, নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সিনিয়র ন্যাশনাল এডভাইজার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ শাহ মনির হোসেন এবং নিরাপদ খাদ্য ভ্যালুচেইন যেখানে নজর দিতে হবে শীর্ষক মূল বক্তব্য তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর সাবেক পরিচালক কৃষি বিজ্ঞানী ডঃ জয়নুল আবেদীন।
ক্যাব সভাপতি ও সাবেক দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সভাপতিত্বে নিরাপদ খাদ্য সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে “নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনে তৃণমূল সংলাপ” পর্বে সারা দেশ থেকে আগত নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের সংগঠকবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন হাঙ্গারফ্রি ওয়ার্ল্ড এর কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউর রহমান মিটন।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে নাগরিক সমাজের ঢাকা ঘোষণা ২০১৭
১. সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করতে হবে।
২. নিরাপদ খাদ্য ভ্যালুচেইন শক্তি শালী ও ফলপ্রসু করতে হলে নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়নের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠন পূর্বক বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
৪. ‘যুবরাই আমাদের ভবিষ্যত’। সে কারণে নিরাপদ খাদ্য প্রসারের অভিযানে যুবদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৫. নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনে কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ গঠনে সহায়তা প্রদান করতে হবে।
৬.যথাযথ প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রসারে সামাজিক উদ্যোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব অবসানের পাশাপাশি সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি সহজতর করতে হবে।
৭. নিরাপদ খাদ্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
৮. প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
৯. ‘খাদ্যমান মনিটরিং’ ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে।প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি এক্ষেত্রে ‘সামাজিক প্রত্যয়ন’ বা ‘পিজিএস’ ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে হবে।
১০. নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন বৃদ্ধির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহকে এগিয়ে আসতে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
১১. খাদ্য অধিকার ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে ‘গণমুখী নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা’ গড়ে তুলতে হবে।
১২. পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে প্রচারণা জোরদার করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
১৩. নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ যথাযথ ভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সামাজিক উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
১৪. আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে তবে আইন প্রয়োগের নামে খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনে নিয়োজিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
১৫. ‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘নিরাপদ খাদ্য সহায়ক (সেফ ফুড ফ্যাসিলিটেটর)’ বা অনুরূপ সম্মাননা প্রদানের বিধান করতে হবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন) দেশের নাগরিক সমাজের প্লাটফরম হিসেবে কাজ করছে। এই নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালীও আরও বিস্তৃত করার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে আহ্বান জানানো হয়।