বিচারকদের নিয়ে কটু মন্তব্য করায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ‘রং হেডেড’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তিনি যে ‘রং হেডেড’ না-এটা প্রমাণ করতে গিয়ে যা করছেন, তাতে উল্টো ফলই ফলছে! তাতে কী, তার নাম কিন্তু বেশ ফাটছে! জীবনে নাম ফাটানোটাও একটা বড় কৃতিত্ব নয় কী? অবশ্য এর জন্য মিডিয়াকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। আমাদের মিডিয়া কিছু ব্যক্তিকে মাঝে মাঝে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরীও মিডিয়ার কাছে একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। বিতর্কিত সব মন্তব্য করেন। মিডিয়ায় সেগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছাপাও হয়। অনেকে এসব মন্তব্যে বেশ আমোদিতও হন।
একদা মুক্তিযোদ্ধা এই ভদ্রলোকটি অনেকদিন ধরেই বিএনপি-জামায়াতের পরামর্শক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন। ইনকিলাব, অধুনালুপ্ত আমার দেশ, নয়াদিগন্ত প্রভৃতি পত্রিকা তার প্রতিটি বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করে। তিনি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ টিভি চ্যানেলগুলোর টকশোরও জনপ্রিয় মুখ। ‘মৌলবাদ-বান্ধব’ তার বিভিন্ন মত-মন্তব্য মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়, ‘জেহাদি’ ভাইয়েরা সারাদিন ধরে সে খবর শেয়ার করে।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি জিয়ার খুব কাছের লোক ছিলেন। তারপর তিনি এরশাদের উপদেষ্টা/মন্ত্রী হয়েছিলেন। এডাবের চেয়ারম্যান থাকার সময় এরশাদকে নিয়ে এনজিও মহাসম্মেলন করেছিলেন। আবার এরশাদের পতনের পর খুব দ্রুত বেগম জিয়ার আস্থাভাজন হয়েছিলেন। এখনও আছেন। সেই সঙ্গে জামায়াতেরও আস্থাভাজন হয়েছেন।
মাত্র কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, ‘জাকির নায়েকের বক্তব্যে জঙ্গির উত্থান হয় না, জঙ্গির উত্থান হয় রাষ্ট্রের অন্যায় বিচারে। সন্তানের সামনে যখন একজন পিতার ওপর অন্যায় জুলুম, চাঁদাবাজি করা হয় এবং যখন তার কোনো বিচার হয় না, তখনই সেই সন্তানেরা জঙ্গিবাদে লিপ্ত হয়।’ তার কথাগুলো যে সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য তা সবাই বোঝেন। তিনি নিজেও বোঝেন। তিনি ভালো করেই জানেন, কি বললে মিডিয়ায় আরো একটু লাইম লাইটে থাকা যাবে। আমি নিশ্চিত, নির্দোষ বাবাকে জঙ্গি বলে চালান করে দেওয়ায় ছেলে ক্ষোভে সত্যি সত্যি জঙ্গি হয়ে গেছে, এরকম একজনের নামও তিনি বলতে পারবেন না। নাসিফ, নিবরাস, ফাইজুল্লাহ, আবীর, তাহমিদ, তৌসিক এরকম শত শত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের কোনো বাবাকে ধরে নিয়ে কোর্টে জঙ্গি বলে চালান করে দেয়া হয়েছে-এমন তথ্য আমরা পাইনি। নিশ্চয়ই তার কাছেও নেই। তবু তিনি এমন মন্তব্য করেছেন!
যাহোক, বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ইতিমধ্যেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত বিএনপির সাবেক নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পেছনে ফেলা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সর্বশেষ ২০ দলীয় জোটনেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে একটি দীর্ঘ খোলা চিঠি লিখে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন।
এই চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনায় যাব না, তাহলে ‘মহাভারত’ হয়ে যাবে। আমরা বরং এই চিঠির একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করব। চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের কয়েকজন নামজাদা বুদ্ধিজীবীর ‘নিরপেক্ষতা’র কাছা ধরে নির্মমভাবে টান মেরেছেন! যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা কসরতে নিজেদের ‘নিরপেক্ষতার সতীত্ব’ অক্ষুন্ন রাখার প্রাণান্ত প্রয়াস চালাচ্ছিলেন, তিনি তাদের একটি বিশেষ শিবিরে ঠেলে দিয়েছেন! তাদের চরিত্রে ‘জাতীয়তাবাদী-ট্যাগ’ লাগানোর চেষ্টা করেছেন।
খোলা চিঠিতে তিনি খালেদা জিয়াকে উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘‘দলের (বিএনপি) সদস্য নয় অথচ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী, যোগ্যতাসম্পন্ন ও সুদক্ষ ব্যক্তিদের কোঅপ্ট করার বিধান আছে। এ বিধানবলে অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ, অধ্যাপক আহমেদ কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ফেরদৌস আজিম, উপাচার্য পারভীন হাসান, নারী পক্ষের শিরীন হক, অধ্যাপক আইনুন নিশাত, অধ্যাপক (ড.) এম আর খান, বারডেমের ডা. একে আজাদ খান, আসিফ নজরুল, দিলারা চৌধুরী, বদিউল আলম মজুমদার, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, বিআইডিএসের বিনায়ক সেন, সাবেক আমলা আলী ইমাম মজুমদার, সা’দত হোসেন, শওকত আলী, আকবর আলী খানসহ আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কোঅপ্ট করলে কমিটির কাজের গুরুত্ব বাড়বে এবং বিএনপি জ্ঞানসমৃদ্ধ হবে ও ভবিষ্যতে দেশ শাসনে আপনার সুবিধা হবে।’’
বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির প্রতি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই পরামর্শ যে অত্যন্ত মহৎ ও উপকারী-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সমস্যা হলো অতঃপর এই বুদ্ধিজীবীদের যদি বেগম জিয়া কোঅপ্ট না করেন, তাহলে এই মহামহিমদের কী হবে? জাফরুল্লাহ সাহেব নিশ্চয়ই জেনে-বুঝেই এই নামগুলো প্রস্তাব করেছেন! উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ নিশ্চয়ই চিন্তা-চেতনায় বিএনপির সঙ্গে ‘ফিট’ করে! তা না হলে দেশে বিভিন্ন সেক্টরের শত শত বুদ্ধিজীবী থাকলেও মাত্র এই কজনকেই তিনি কেন বিএনপির দলীয় জামা গায়ে পড়ানোর জন্য প্রস্তাব করবেন?
এই নাম প্রস্তাবের পরে উল্লিখিত কোনো বুদ্ধিজীবীর পক্ষ থেকেই কোনো প্রতিবাদ বা আপত্তি আসেনি। না আসাটা অবশ্য ভালোর মধ্যেই পড়ে। রাজনীতিতে মত ও দলের উত্থানপতন ঘটবে, শাসক ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা সর্বদাই মহাপ্রসাদ খাবেন, লাল-নীল বাতিওয়ালা গাড়িতে চড়বেন, আমোদ-ফুর্তি করবেন এবং প্রৌঢ়ত্বে বা বার্ধক্যে পৌঁছেও বালকবালিকাসুলভ আচরণ করবেন, যেন তারা ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না।
আমাদের দেশে তো বুদ্ধিজীবীরাও দুই ভাগে বিভক্ত। আওয়ামী পক্ষ ও বিএনপি-জামায়াত পক্ষ। এর বাইরে আরেকটি ধারা আছে বটে, তবে তারা খুব একটা কল্কে পান না। অনেকে অবোধ অবশ্য প্রশ্ন তোলেন, এরা কেমন বুদ্ধিজীবী? সুবুদ্ধিজীবী না দুর্বুদ্ধিজীবী? আমার মনে হয়, সময় এসেছে বুদ্ধিজীবীদের স্পষ্ট শ্রেণিবিভক্ত করার। যে সব রাজনৈতিক দল তাদের কাজকর্ম সামলানোর জন্য অথবা দলভারী করার অভিপ্রায়ে বুদ্ধিজীবী নিয়োগে আগ্রহী, তাদের এই শ্রেণিবিভাগ করতে হবে, নাহলে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। দলে যত বেশি বোদ্ধা বাড়বে যোদ্ধার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কমতে থাকবে। তাতে রাজপথে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ হবে। ‘ষড়যন্ত্র’ বা ‘বুদ্ধির খেলা’ ছাড়া রাজনীতিতে অন্য কোনো নীতি থাকবে না। আমরা জনগণ একটু শান্তিতে থাকতে পারব। আর দলীয় বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য শুনে আমরাও দলবাজরাও সমৃদ্ধ হতে পারব!
একজন চিত্রসমালোচক জাঁ লুক গোদারের সিনেমার আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘কুকুর কখনও উলঙ্গ নয়, কারণ সে সারাক্ষণই উলঙ্গ।’ মানুষের ক্ষেত্রে এটি একটু অন্যভাবে বলা যায়, ‘কাপড়ের নীচে সকলেই উলঙ্গ’। আর উলঙ্গ যখন, তখন আবরণটির কথা না-ই বা মনে থাকল। বরং বুদ্ধিটা ঠিক মতো প্রয়োগ করলেই আচরণটিকে মায়া বা বিভ্রম বলে মনে হবে। আর মায়াই যখন, তখন সেটিকে কায়া থেকে একটু দূরে সরিয়ে ‘আখের-বাজি’করাই ভালো। সত্যি কথা বলতে কী, দলমতনির্বিশেষে আখের রস সব সময়েই মিষ্টি; সময় মতো, সুযোগ মতো জার্সি বদলে বদলে যদি মিষ্টি পানীয় পাওয়া যায়, ক্ষতি কী! নিন্দুকেরা হয়তো তাতে বেহায়া বলবে। তা বলুক, ওইটুকু (লজ্জা-ঘৃণা-ভয়) উপেক্ষা না করলে কি আর বড় মাপের বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়!
সাহেবদের কালে বঙ্গদেশের নবজাগরণ, ইংরেজি শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্তি, ইত্যাদি ঘটনার ফলে বুদ্ধি যে ভাবে বিকশিত হলো, মেরুদণ্ডটি তো সে ভাবে শক্তপোক্ত হয়নি। ইংরেজরা মেরুদণ্ড নির্মাণের শিক্ষাও আমাদের দিয়ে যায়নি।
আমাদের রাজনীতি যখন সর্বনাশের পথে শনৈ শনৈ ধাবমান, তখন দলের ক্ষীর-ননী খাওয়া নধর বুদ্ধিজীবী তাকে হুঁশিয়ার করা তো দূরের কথা, বরং পরামর্শ দিয়ে, হাততালি দিয়ে পতনের গতিবৃদ্ধিতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। সাবাস ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবাস!
খাঁচার পাখি আকাশে উড়বেই। কিন্তু সেই আকাশই যদি হয় পাখির ডানা ছেঁটে ফেলার মস্ত পরিসর, তবে তো পাখিটিকে রক্ষা করার উপায় আকাশেই তৈরি হতে হবে জীবনের নিয়মে! কিন্তু আমরা যে নিয়মের শিকলে বাধা পড়তে চাই না, আমরা নিয়ম ভাঙ্গতে চাই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)