সাম্প্রতিক বাংলাদেশি নির্মাতাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচিত নাম রুবাইয়াত হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’ দিয়ে ২০১১ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দ্বিতীয় নির্মাণ ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’। ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। নির্মাতার তৃতীয় ছবি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। যা দেশে মুক্তির আগেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, শহরে মুক্তি পেয়েছে। শিগগির বাংলাদেশেও মুক্তি পেতে যাচ্ছে। কী আছে রুবাইয়াত হোসেনের এই ছবিতে? তা জানাতেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গুলশানের বাসায় বসে তিনি কথা বলেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে…
কোন ভাবনা মাথায় নিয়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নির্মাণ করলেন?
একজন নারী পোশাক শ্রমিক যার নাম ডালিয়া আক্তার, তার জীবনের গল্প থেকে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নির্মিত হয়েছে। ২০১৬ সালে আমার একজন বান্ধবীর মাধ্যমে ডালিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। রামপুরার একটি গার্মেন্টসে সে কাজ করতো। ইউনিয়ন লিডার ছিল। তারপর ডালিয়া অন্তঃসত্ত্বা থাকে। ডালিয়ার জীবন কাহিনি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমি ছবিটি বানিয়েছি। গার্মেন্টসে কাজ করেও ব্যক্তিগত ও পেশাজীবন ব্যালেন্স করে নারী ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করছে সেটা তুলে ধরেছি। এটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মাণ করেছি। আমি কখনো দেখিনি একজন নারী গার্মেন্টসকে ফিল্মে হিরোর মতো এগিয়ে চলতে। এই ফিল্মে ডালিয়াই হিরো। দুই বছরের বেশি সময় ধরে গল্প ও চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেছি, ২০১৮ সালের এপ্রিলে শুটিং শুরু করি। ৩৬ দিন লেগেছে শুটিং করতে। কম সময়ে কাজ করতে পেরেছি কারণ, প্রি-প্রোডাকশন করেছি খুব ভালো করে। অভিনয় না করলেও ডালিয়া পুরোটা সময় আমার সঙ্গে ছিল। তার চরিত্রটি করেছে রিকিতা নন্দিনী শিমু। চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে এখানে যারা অভিনয় করেছেন প্রত্যেককেই ডালিয়া জানিয়েছে পোশাক শ্রমিকদের দিনযাপন কেমন!
আপনার আগের ছবি ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এও গার্মেন্টস একটা বিরাট জায়গা নিয়ে ছিলো। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-এও তাই। পোশাকশিল্পকেই কেন আপনি সিনেমার জন্য বার বার বেছে নিচ্ছেন? বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য?
যখন ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এর স্ক্রিপ্ট লিখছিলাম তখন রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ে। ওই সময় সেটি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ করেছি ডালিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বলে। এরপর ডালিয়া চলে গেছে জর্ডানে। সে বলেছে, আপা এবার প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা যায় কিনা দেখেন! সিনেমা জিনিসটা একটার পর একটা চলে আসে। নিজেরও অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ থাকে না কোনটা তৈরি হবে। একটা কথা আছে, ‘দ্য ডিরেক্টর ডাজেন্ট চুজ দ্য ফিল্ম, দ্য ফিল্ম চুজেস দ্য ডিরেক্টর’। এখন আমি অনুপ্রাণিত হচ্ছি, প্রবাসী নারী শ্রমিকের জীবন নিয়ে একটা কাজ করবো। আমেরিকা থেকে ফেরার পথে দুবাইতে কিছু নারী শ্রমিক দেখেছি। তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি।
বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। এরমধ্যে একজন ডালিয়ার জীবন কাহিনিতে কী এমন পেলেন?
ডালিয়া আক্তারের প্রতি যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল তা হলো এম্পাওয়ার্মেন্ট (ক্ষমতায়ন)। এছাড়া তার সাহস, সংগ্রামের সঙ্গে আনন্দ, গতি এসবকিছু আমাকে টেনেছে। ১১ বছর বয়সে গ্রামে ডালিয়াকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়। সে পালিয়ে শহরে এসে জুতার কারখানা ও মানুষের বাসায় কাজ নেয়। এরপর সে গার্মেন্টসে কাজ করে। সবশেষে দেখা যায় ডালিয়া ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট! এটা একটা এম্পাওয়ার্মেন্ট’র গল্প। অল্প বয়সে ডালিয়ার যদি বিয়ে হতো তাহলে সে গার্মন্টেসের ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট হতো না, তাকে নিয়ে এই ফিল্মও হতো না। এখানেই শেষ না, ফ্রান্স-ডেনমার্কে গিয়ে বিশ্বের বড় বড় মিডিয়ার সামনে গিয়ে ডালিয়া কথাও বলতে পারতো না। আমি যখন ডকুমেন্টারির জন্য রিসার্চ করছিলাম, তখন পোশাক শ্রমিকদের ভিকটিম হিসেবে দেখতে পেয়েছি। বারবার রানা প্লাজা ধ্বসে মরদেহ সামনে চলে এসেছে। কিন্তু তারা কতোটা সাহসী, সংগ্রামী হয়ে গার্মেন্টসে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে তাদের দাবী প্রতিষ্ঠা করতে পারছে এগুলোই আমার ছবিতে হাইলাইট করেছি। ডালিয়া তার জীবনে সংগ্রাম করে ও ২০১৩ সালে মাত্র ২১ বছরে সবশেষে তার ফ্যাক্টরিতে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। এর পাশাপাশি ২১ দফা দাবি দিয়ে ১৭ টি দাবি সে আদায় করে। আমার কাছে এটা অনুপ্রেরণার গল্প।
তার মানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে আপনি নারী শ্রমিকদের একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন?
বাংলাদেশের নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভিকটিম ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা প্রতিবাদ করতে পারে নিজদের অধিকার আদায় করতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে অনেকে মনে করে, বাংলাদেশ মুসলিম দেশ, তাই নারীদের সেভাবে ক্ষমতায়ন হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এদেশে নারীরা অনেক বেশি শক্তিশালী, সংগ্রামী এই বার্তাটাই ছবিতে দিয়েছি। ছবিতে আমি ইতিবাচক বার্তাই দিয়েছি। নারী পোশাক শ্রমিকদের অধিকার ও ক্ষমতা তুলে ধরেছি। ফ্রান্সে যখন ছবিটি দেখিয়েছি, সেখানকার দর্শক অবাক হয়েছে! তারা বলেছে আসলেই কি এদেশের মেয়েরা এভাবে ফাইট করতে জানে? তখন ডালিয়া আমার সঙ্গেই ছিল। সে নিজেই সেখানে তার ফাইটের ব্যাখ্যা দিয়েছে।
‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এদেশের নারী গার্মেন্টস শ্রমিকদের দেখানোর জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা থাকবে?
শুধু মাল্টিপ্লেক্স নয়, সাধারণ স্ক্রিন যেখানে যেখানে আছে সবখানেই ছবিটি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো। বিশেষ ব্যবস্থা বলতে, অনলাইনে ছবিটা পরিবেশনার চেষ্টা হচ্ছে। কারণ, যে শ্রমিক দিনে ১০ ঘণ্টা ও সপ্তাহে ৬দিন কাজ করে; তারা বেশিরভাগ সময় ফোনেই ছবি বা নাটক দেখে কাটে। ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে মিশে দেখেছি, তারা সেভাবে হলে গিয়ে ছবি দেখার সুযোগ পায়না। ডালিয়াই আমাকে বলেছে, সে জীবনে দু’বার সিনেমা হলে গিয়েছে। বিয়ের পর তার স্বামীর সঙ্গে হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে, আর এবার ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর সময়। আমার ইচ্ছে আছে, স্ক্রিনে মুক্তি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনের স্ট্রিমিং রয়েছে সেখানেও মুক্তি দেওয়া। যাতে করে সমস্ত শ্রমিক যেন দেখতে পারে। এছাড়া শ্রমিকদের কাছে গিয়ে হয়তো বিশেষ কিছু শো’র আয়োজন করা। তারা যখন ছবিটা দেখবে তখন ভেতরে ভেতরে অনুপ্রাণিত হবে। বুঝবে যে বিশ্বের কাছে তাদের নিয়ে কেউ রিপ্রেজেন্ট করলো।
‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ দেখার পর ডালিয়ার অনুভূতি কেমন ছিলো?
সে বলেছে, কত বড় কাজ করেছে নিজেও বোঝে নাই। ছবি দেখার সময় মানুষের করতালিতে সে রিয়েলাইজ করেছে, অনেক বড় কাজ সে করে ফেলেছে। ডালিয়াদের কাছে গিয়ে কেউ বলে না যে, তাদের জন্যই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ। তাদের পরিশ্রমের কারণেই দিনের পর দিন বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। ডালিয়া ছবি দেখে এটা বুঝতে পেরেছে। ফ্রান্সের একটি টিভিতে ডালিয়া ইন্টার্ভিউ দিয়েছে। সেখানে তাকে হিরো হিসেবে সেলিব্রেট করা হয়েছে। ওই জায়গাটা এতো গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েক বছর আগে সেখানে ম্যাডোনার ইন্টার্ভিউ নেওয়া হয়েছে। সেখানে ডালিয়া একজন বাংলাদেশি পোশাক শ্রমিক হিসেবে ইন্টার্ভিউ দিয়েছে। এটাই তো নারীর ক্ষমতায়ন।
এখনও পর্যন্ত বিশ্বের কতোগুলো স্থানে প্রদর্শিত হয়েছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’?
গত সেপ্টেম্বরে কানাডার ‘টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল’-এ ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে। পরে লন্ডন বিএফআই ফেস্টিভ্যালসহ বেশকিছু বড় বড় ফেস্টিভালে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া ফ্রান্সের ৫১টি থিয়েটার, ডেনমার্কে ৭টি থিয়েটার, পর্তুগালের ১টি থিয়েটারে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। বর্তমানে পঞ্চম সপ্তাহ চলছে ফান্সের ৬৪টি থিয়েটারে। সেখানে ছবিটি খুব ভালো চলছে। কারণ, শুরু হয়েছিলো ৫১ হল দিয়ে, এখন পঞ্চম সপ্তাহে চলছে ৬৪ হলে।
বাংলাদেশে কবে মুক্তি পাবে?
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আসতে পারে। তবে চূড়ান্ত নয়। তার আগে নারী দিবস (৮ মার্চ)। ওই উপলক্ষেও দিতে পারি। কারণ, ছবিটা নারীর ক্ষমতায় নিয়ে। নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে মুক্তি দিতে পারলে খুব ভালো হবে।
ইউরোপে অভিজাত এসব শহরে এতোগুলো হলে চলছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিকমতো প্রদর্শিত হবে তো?
নাচ-গান থাকে না বলে হল পাওয়া খুব মুশকিল। মেহেরজান ৭টি হলে ছিল, আন্ডার কনস্ট্রাকশন ৫টি হলে ছিল। খুবই কষ্টের ব্যাপার। বলাকায় ১২০০ সিট। এক সপ্তাহের বেশি ছবি থাকে না। কারণ এত দর্শক আনা কঠিন। নিজের দেশেই হল পাইনা, সেখানে ফ্রান্সে যখন পঞ্চম সপ্তাহে ৬৪ হলে আমার ছবি চলছে সেটা খুবই আশা ব্যঞ্জক। জানুয়ারি মাস জুড়ে সেখানে চলবে। আমাদের ছবির গ্লোবাল মার্কেট এখন তৈরি হচ্ছে। ভালো ছবি বানিয়ে সারা পৃথিবীকে আমরা দেখাতে পারি। দেখি এবার চেষ্টা থাকবে আরও বেশি হলে প্রদর্শনের কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা!
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হোম ভিডিও প্লাটফর্ম ক্রাইটেরিয়ন কালেকশানের চলচ্চিত্র সাময়িকী ‘দ্য কারেন্ট’-এর তালিকায় দশক সেরা ছবির তালিকায় ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। প্রথম বাংলাদেশি নির্মাতা হিসেবে এই অনুভূতি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এটা আমার জন্য খুব সারপ্রাইজিং ছিল। কারণ ক্রাইটেরিয়নে সত্যজিৎ রায়, ঋতিক ঘটকের ফিল্ম রিস্টোর করে থাকে। তারা একেবারে আর্ট হাউজ প্লাটফর্ম, এক্সক্লুসিভ। কম সংখ্যক ছবি নিয়ে তারা কাজ করে। তারা যখন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে গত দশকের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ছবির মধ্যে একটি হিসেবে রেখেছে, এটা আমার জন্য খুব সারপ্রাইজের ব্যাপার। নিউজটা আমাকে আমেরিকান ডিস্ট্রিবিউটরা মেইলে জানায়। সেখানে তারা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে সত্যজিৎ রায়ের ছবির সঙ্গে তুলনা করা করেছেন! সেটাও আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। কারণ, সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম দেখে আমি ফিল্ম বানানোর আগ্রহ পাই।