চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নিজেকে কেন ‘কণ্ঠশ্রমিক’ দাবী করতেন এন্ড্রু কিশোর?

শিল্পী জীবনে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী এন্ড্রু কিশোরকে খুব একটা দেখা যায়নি। রেকর্ডেড কিংবা হাল সময়ের লাইভ অনুষ্ঠানেও তাঁকে পাওয়া ছিলো বিরল ঘটনা! অথচ অসুস্থ হয়ে গেল বছর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ার মাস দুয়েক আগে তিনি শেষ বারের মতো অংশ নিয়েছিলেন চ্যানেল আইয়ের একটি ঈদ অনুষ্ঠানে।

তাঁকে সম্মান জানিয়ে নির্মিত বিশেষ সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিলো ‘কত রঙ্গ জানো রে মানুষ’। যেখানে শুধু গান করেননি তিনি, কথা বলেছেন ক্যারিয়ারের বিভিন্ন বাঁক বদলের। অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনায় ছিলেন নন্দিত অভিনেত্রী আফসানা মিমি, আর প্রযোজক ছিলেন অনন্যা রুমা।

এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ আট বছর পর কোনো টেলেভিশনে স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। সেই অনুষ্ঠানে গানের ফাঁকে ফাঁকে আফসানা মিমির প্রশ্নের উত্তরে কী বলেছিলেন এই শিল্পী? তার কিছু অংশ থাকলো চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য:

‘কত রঙ্গ জানো রে মানুষ, কত রঙ্গ জানো’ গানটির গল্পটা কী, আমাদের বলবেন?
১৯৮২ সালের দিকে আলম খান ভাইয়ের বাসায় তার গানের ঘরে বসে প্রথম গানটির ভাবনা মাথায় এসেছিল। গানটি মূলত জহিরুল হক ভাইয়ের ‘প্রাণ সজনী’ চলচ্চিত্রের জন্য করা হয়। যার গীতিকার ছিলেন মনিরুজ্জামান মনির। তখনকার সময়ে একটি গান নির্মাণ করতে অনেক সময় দিতে হতো। অনেকগুলো মানুষের মেধা, ত্যাগ ও শ্রম ব্যয় হতো একটি গানের পেছনে। এই ‘কত রঙ্গ জানো রে মানুষ, কত রঙ্গ জানো’ গানটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গানটির সবচেয়ে মজার বিষয়টি ছিল এর লিরিক। কেননা অন্যান্য গানের লিরিকের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও এই গানটির ছিল আমাদের প্রচলিত জীবন নিয়েই।

এছাড়াও গানটি আমার কাছে খুবই স্মরণীয় কেননা এই এক ‘কত রঙ্গ জানো রে মানুষ, কত রঙ্গ জানো’ গানটি আমি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চার বার গেয়েছি। প্রথমবার ‘প্রাণ সজনী’তে, এরপর ‘প্রাণ সজনী’ রঙিনভাবে নির্মাণের সময়, তারপর ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘প্রাণ সজনী’ নির্মাণের সময় এবং সর্বশেষ ভারতীয় বাংলা সিনেমায় গানটি যখন রিমিক্স হয় তখনও গানটি আমিই গেয়েছিলাম। ভিন্ন ভিন্নভাবে এই এক গান গাওয়ার বিষয়টি আমার জন্য খুবই ভালো লাগার একটি বিষয়। চার বার আলাদা ভাবে গানটি গেয়ে এক ধরনের মায়া জন্মে গেছে গানটির প্রতি।

আফসানা মিমির সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর

এন্ড্রু কিশোর একজন ‘কণ্ঠশ্রমিক’ হিসেবে নিজেকে কেন দাবী করেন?
হ্যাঁ, নিজেকে একজন কণ্ঠশ্রমিক হিসেবে দাবী করি আমি। এবং এটা আমারই উদ্ভাবন করা একটি শব্দ। কারণ, আমি মনে করি এই গান গেয়েই আমি জীবন ধারণ করি। গানই আমার জীবিকা অর্জনের একমাত্র পথ, তাই আমি নিজেকে কণ্ঠশ্রমিক দাবী করি। তাছাড়া কথা কিংবা সুরের ওপর আমার এতটা জ্ঞান নেই। জ্ঞান শুধু গায়কীতে। তাই গীতিকার কিংবা সুরকারের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না আমি। তবে আমি যেহেতু আধুনিক গান গাই এবং গান গেয়েই দর্শকের বাহবা পাই এবং অর্থ উপার্জন করি; সুতরাং, আমি তো শিল্পী না। আমি শ্রমিক। গান গেয়ে সেটির পেছনে শ্রম দিয়ে আমি উপার্জন করি। আমি এটাকে আমার কাজ হিসেবে বিবেচনা করেই নিজেকে কণ্ঠশ্রমিক হিসেবে দাবি করি।

একজন গায়ক হিসেবে দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে অনেক গানই তো গেয়েছেন, কিন্তু তারপরেও এখনো নতুন গান পেলে সেখানে কি খোঁজেন?
আমি যেহেতু বরাবরই আধুনিক গান গেয়ে আসেছি তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটা হয়েছে আমাকে চলচ্চিত্রের গানই গাইতে হয়। সেক্ষেত্রে দর্শকদের মন পর্যন্ত গানটি পৌঁছে দেওয়া আরো কঠিন বিষয়। কেননা গানটি হয়ত একজন গায়ক হিসেবে আমি গাইবো, সুরকার ও গীতিকার থাকবেন অন্য কেউ, কিন্ত গানটি দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা হবে কোন নায়কের দ্বারা। সেক্ষেত্রে তার মুখে গানটি দেখে শুনে দর্শকদের হৃদয়ের কোন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছাবে সেটির ধারণা আসলে আগেই পাওয়া যায় না। ফলে এটা সত্যিই কঠিন একটি বিষয়।

‘একটা গোলাপ হাতে নিয়ে লাইনে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে’ গানটির কি কোন গল্প আছে?
এই গানটি লিখেছিলেন জিয়া আহমেদ শেলী এবং সুর করেছিলেন আলাউদ্দিন আলী। গানটি মূলত একজন মানুষের পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ইহকাল ছেড়ে যাওয়ার পরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা। কারণ একজন মানুষের মৃত্যুর পর তাকে বিদায় দিতে সবার আহাজারি শুরু হয়ে যায় কিন্তু ঠিক সেই মানুষটা তখন কী অবস্থায় থাকে তার ধারণা কিন্তু অন্য কারোই থাকে না। মৃত সেই মানুষটির মনের কথাগুলো নিয়েই মূলত এই গানটি তৈরী করা হয়েছিলো। গানটির এতটাই মর্ম আছে যে এর প্রতিটি লাইনই মনে গেঁথে যাওয়ার মত।

চ্যানেল আইয়ের স্টুডিওতে এন্ড্রু কিশোর

‘ফুলের গন্ধের মত থেকে যাবো তোমার রুমালে’-প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের অপ্রকাশিত এই লেখাটি নিয়ে যদি কিছু বলতেন?
আমরা যাকে সব্যসাচী লেখক বলে থাকি তিনি হলেন আমাদের শামসুল হক ভাই। এই হক ভাইয়ের লেখা ‘হায়রে মানুষ, রঙ্গিন ফানুস’ গানটি গেয়েই ১৯৮২ সালে আমি প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। কিন্তু তার সাথে আমার পরিচয় থাকলেও কখনোই খুব নিবিড় কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তিনি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম আমি। এবং সেখানে যাওয়ার পরই তিনি তার কিছু অপ্রকাশিত লেখা নিয়ে আমাকে একটি গান করতে বলেছিলেন। এরপর তিনি যখন মারা যান তারপরে আমি এবং আলম খান ভাই মিলে তার অপ্রকাশিত লেখা গুলোর ভেতর এই লেখাটিকে গানে পরিণত করি। জানি না আমরা কতটা স্বার্থক তবে চেষ্টা করেছিলাম ভালো কিছু করার। দর্শক মনে গানটি পৌঁছাতে পারলেই আমরা নিজেদের স্বার্থক বলে দাবি করতে পারবো।