কয়েক বছরে দেশে আশংকাজনক হারে বেড়েছে শিশু অপহরণ এবং অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে এসে শিশু নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনা বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। শিশু অপহরণের পর পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপের অভাবেই হত্যার ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ থাকলেও পুলিশ তা অস্বীকার করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারি মহাপরিদর্শক (এআইজি, মিডিয়া) মো. নজরুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন: নিষ্ক্রিয়তার কোনো সুযোগ নেই। যখনই কোনো শিশু অপহরণের শিকার হচ্ছে পুলিশ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ওই ঘটনার তদন্ত করছে।
‘নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই না,’ দাবি করে তিনি বলেন, যারা এ ধরনের অভিযোগ করছেন আমি তাদের বলবো আপনাদের কাছে কোন তথ্য কিংবা ডকুমেন্ট থাকলে সবার সামনে নিয়ে আসুন।
আসক’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে শিশু অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা ছিলো ৯৯টি। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৩-এ।
কিন্তু, শিশু অপহরণ, নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ এবং মানবাধিকার কর্মী সকলেই দিচ্ছেন একই রকম উত্তর। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, টাকা উপার্জনের সহজ পথ কিংবা ব্যক্তিগত ক্রোধ মেটাতেই শিশুরা বারবার এ ধরনের ঘটনার শিকার হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। আর এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দিচ্ছেন সবার আগে নিজেদের সচেতন হওয়ার তাগিদ।
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা যদি অপহরণের ঘটনাগুলো দেখি তাহলে দেখবো টাকা উপার্জন কিংবা পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ক্রোধ মেটাতেই শিশু অপহরণের হার আগের তুলনায় বেড়েছে।
‘অপহরণকরীরা এটাকে এখন টাকা উপার্জনের সহজ পথ বলে মনে করছে। আবার সম্পত্তির বিরোধের প্রতিশোধ নিতেও এগুলো করা হচ্ছে। এটা কিন্তু বাইরের কেউ করছে না। আশে পাশের পরিচিতজনেরাই এগুলো করে থাকে,’ বলে উল্লেখ করে তিনি বিভিন্ন ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সহকারি মহাপরিদর্শক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু পরিচিতজনেরাই এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তাই সহজেই প্রতিরোধ করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।’
রংপুরের মিঠাপুকুরে সাড়ে ৪ বছরের শিশু রাহিমুল ইসলাম রনক হত্যার ঘটনা টেনে এনে তিনি বলেন, অপরহরণকারী মোবাশ্বের আলম এবং শিশু রনকের পিতা আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই। তাদের ভেতর ৮০ হাজার টাকা লেনদেনের একটা ব্যাপার ছিলো। এ টাকা লেনদেনের দ্বন্দ্বের জেরেই গতবছর ১ ডিসেম্বর রনককে অপরহণ করা হয়।
দুই মাস আগে শিশু রনক অপহরণের পর শুক্রবার মাটি খুঁড়ে রনকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গলাকাটা মৃতদেহটি বস্তাবন্দী করে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো।
অপহরণের ঘটনার পর অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার প্রসঙ্গটি তুলে ধরে এলিনা খান বলেন: যেহেতু পরিচিতজনেরাই অপহরণের ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তাই কোনো না কোনো সময় শিশু অপহরণকারীকে চিনে ফেলছে। এক্ষেত্রে পরিচয় গোপন করার জন্য অপহরণকারীরা হত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
অপহরণকারীরা শিশুদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই শিশুদের প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই, তাই শিশুদের প্রতিশোধের হাতিয়ার এবং অভিভাবকের ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে অপহরণকারীরা।’
তবে অনেক ক্ষেত্রে উদ্ধারে পুলিশের সদিচ্ছার অভাবকেও দায়ী করছেন এলিনা খান।
‘একটা শিশু যখন অপহরণ হচ্ছে তখন কি হচ্ছে? অপহৃত শিশুর অভিভাবক প্রথমেই পুলিশের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু পুলিশের দ্রুত তৎপরতার অভাবে অনেকক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু, যখনই শিশুটিকে হত্যা করা হচ্ছে, মিডিয়ার আলোচনা হচ্ছে তখনই পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠছে। আগে থেকে এ তৎপরতা চালালে হত্যার ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যেতো,’ বলে দাবি করেন তিনি।
পুলিশের এআইজি নজরুল ইসলাম এমন অভিযোগ নাকচ করে সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ দাবি করেছেন। শিশু অহরণের ঘটনায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পুলিশ তদন্ত ও উদ্ধারে নামে বলে দাবি করেন তিনি।
কিন্তু, মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য অন্যরকম।
বিত্তবানদের ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্নরকম হয় দাবি করে এলিনা খান বলেন: যে অভিভাবকেরা পুলিশকে টাকা দিতে পারছে তাদের ক্ষেত্রে পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু যারা পারছে না, কিছুদিন আটক থাকার পর শিশুটি হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে।