বর্তমানে ভয়াবহ হারে বেড়ে চলেছে শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনা। বাবা-মায়ের অজান্তে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কোন না কোন শিশুর জীবনে ঘটে চলেছে এ ঘটনা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন সপ্তাহে গড়ে ৩ থেকে ৪ জন এ ধরণের শিশু তারা পেয়ে থাকেন। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, এসব শিশুদের বেশিরভাগই তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হয়।
জানা গেছে, শুধু মেয়ে শিশুরাই নয় ছেলে শিশুরাও শিকার হচ্ছে নির্যাতনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে শিশুরা হারিয়ে ফেলছে তাদের মধুর শৈশব। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সারা জীবনের জন্য। এজন্য বাবা-মায়ের শিথিল পারিবারিক বন্ধন, সন্তানদের প্রতি উদাসীনতা, প্রযুক্তির অপব্যবহার, অল্প বয়সেই স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করছেন তারা।
দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট রাইমা (ছদ্মনাম)। বয়স ১১। বাবা থাকেন সৌদি আরবে। জন্মের পর থেকেই বাবার তেমন কোন স্মৃতি নেই রাইমার। মায়ের সাথে বাবার সম্পর্ক যে ভালো না এ বিষয়টি বেশ ভালোই বোঝে সে। তবে সম্পর্ক ভালো না হলেও প্রতিমাসে বাবা ঠিকই টাকা পাঠিয়ে নিজের দায়িত্ব সারেন।
রাইমাদের বাসায় প্রতিদিনই তার মায়ের বন্ধু আসে। যাকে দেখে রাইমারা দুই ভাই-বোন যেমন খুশি হয়। তেমন খুশি হন তাদের মা। সন্তানদের খুশি দেখে ভীষণ খুশি মা। আর তাই মায়ের সেই বন্ধুকে দেখে শিশু রাইমার যখন তখন তোর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়াটা মোটেও খারাপ লাগেনি মায়ের। বরং মা যেনো বেশ খুশি হতেন তার সন্তানদের এত আনন্দ দেখে।
এভাবেই পেরিয়ে যায় ৩ বছর। মায়ের বন্ধু যখন প্রথম বাসায় আসা শুরু করে তখন রাইমার বয়স ছিলো ৮ বছর। আর এখন তার বয়স ১১ বছর। এই ১১ বছরটাই যেন বিপত্তি হয়ে দেখা দেয় রাইমার জীবনে। হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা অনুভব করতে শুরু করে শিশুটি। মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে জানান শিশুটির প্রসব বেদনা উঠেছে।
পরে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিজারের মাধ্যমে একটি ছেলে সন্তানের মা হয় ১১ বছরের ছোট্ট শিশুটি। এতে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে রাইমার মায়ের মাথায়। পরে ডাক্তার প্রশ্ন করলে শিশুটি জানায়, তার মায়ের বন্ধু গত তিন বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন তার সাথে অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক করে আসছে। প্রথম প্রথম সে বাধা দিলেও একটা সময় পরে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এমনকি শিশুটির সন্তান প্রসবের আগেও রেহাই দেয়া হয়নি তাকে।
পুলিশের কাছে অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বীকার করেছে শিশুটির সম্মতিতেই সে তার সাথে শরীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি বর্তমানে জেলে রয়েছে। আর লোকলজ্জাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে সেফহোমে রাখা হয়েছে সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটিকে।
তবে শিশুটির এ শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন কেন তার মা বুঝতে পারেনি? চিকিৎসকের এ প্রশ্নের উত্তরে তার মা জানায়, তিনি ভেবেছিলেন মেয়ে বড় হচ্ছে সেজন্য মোটা হচ্ছে। আর পেটে ব্যথা হলে ভেবেছেন হয়তোবা মেয়ের পেটে টিউমার হয়েছে। চিকিৎসকদের ধারণা, মা নিজেও শিশুটিকে ঠিকমত সময় দেননি। খেয়াল করেননি। এই কারণে তার অজান্তেই ঘটে গেছে এত বড় দুর্ঘটনা।
শুধু রাইমা নয়, আমাদের সমাজে এমন অনেক শিশু আছে যারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হয়ে হারিয়ে ফেলছে শৈশব। হারিয়ে ফেলছে তাদের স্বাভাবিক জীবন।
এমনই এক ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীর নাম শামিতা (ছদ্মনাম)। কয়েকদিন ধরেই খাবারে রুচি নেই তার। সেই সাথে বমি, পেটে ব্যথা। এ অবস্থায় তাকে চিকিৎকের কাছে নেয়া হলে চিকিৎসকরা যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানায় শামিতা গর্ভবতী।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. ছাবিকুন নাহার চ্যানেল আই অনলইনকে বলেন: ‘প্রতিনিয়ত এরকম ঘটনা ঘটছে। আমাদের কাছে এমন অনেক শিশু আসছে যারা তাদের নিকটাত্মীয়দের দ্বারা অথবা প্রতিবেশী কারো দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।’
শিশুদের এ নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার উপায় হিসেবে তিনি বলেন: ‘সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক তাকে ছোট থেকেই শরীরের গোপন স্থানগুলো সম্পর্কে তাকে জ্ঞান দিতে হবে। বোঝাতে হবে সেসব স্থানে হাত দেবার অধিকার কারো নেই। আর কেউ যদি দিয়েও থাকে তাহলে সে মন্দ।’
বাবা-মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই এ কথাটি শিশুদের বুঝিয়ে বলতে হবে উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বলেন: ‘সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যেকোন বিষয় যেন শিশুরা নির্দ্বিধায় বাবা-মাকে বলতে পারে। নিজেদের ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানকে অনেক বেশি সময় দিতে হবে।’
মানুষের ভেতরে মূল্যবোধগুলো আর কাজ করছে না উল্লেখ করে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘মূল্যবোধের এ অবক্ষয় শিশুদের যৌন হয়রানির প্রথম কারণ। দ্বিতীয়ত, শিশু মাত্রই স্নেহপ্রবণ। তাদেরকে খুব সহজে সামান্য চকলেটের লোভ দেখিয়েই বশে আনা যায়।
তৃতীয়ত, এ ধরনের অসদাচারণের কোন শাস্তি নেই, প্রয়োগ নেই আইনের। বিচারব্যবস্থা রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত যার কারণে অপরাধী খুব সহজেই চলে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।’
চতুর্থ কারণ হিসেবে তিনি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে বলেন: ‘প্রযুক্তিসহ অন্যান্য দিক থেকে আমরা যতো এগোচ্ছি ততো বেশি মাত্রায় সুবিধার পাশাপাশি সমস্যাও বাড়ছে। এখন হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন। চাইলেই সেখানে আমরা যা ইচ্ছে তাই দেখতে পাচ্ছি। এ থেকে মন্দের চর্চা যারা করছে তারাই বেশি এ ধরণের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে।’
এক্ষেত্রে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তিনি শিশুদের সাথে পিতা-মাতার সম্পর্কের বিষয়টিকে জোর দিয়ে তিনি বলেন: ‘সন্তানদের সাথে পিতা-মাতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে মন্দ বিষয়টা তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে না রেখে মন্দটা বুঝিয়ে দিতে হবে। এ ধরনের কোন মন্দ আচরণের সম্মুখীন হলে যেন তা লুকিয়ে না রেখে অবশ্যই বাবা-মাকে অকপটে বলে, তা শিশুদের বুঝাতে হবে।’