সিগারেটের প্যাকেটে বীভৎস সব ছবি। গলায় ঘা, সেখান থেকে মাংস পচে বেরিয়ে আসছে। মুখের ভেতর দাঁতের পাটিতে ধরেছে পচন। এসব ছবির সঙ্গে ‘ধূমপান মৃত্যুর কারণ’, ‘ধূমপান হৃদরোগের কারণ’, ‘ধূমপান ক্যান্সারের কারণ’ লেখা থাকে। সেই প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে দুই আঙুল দিয়ে ফিল্টারটি একটু নাড়িয়ে নাড়িয়ে দুই ঠোঁটে পুরে দেশলাই জ্বাললেই একটি যন্ত্র চালু হয়ে যায়। ধোঁয়া ভেতরে দেহরাজ্যে ঢুকছে, কণ্ঠনালী দিয়ে বুকের ভেতর, পাঁজরের ভেতর ঘুরে আবার নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
যিনি সিগারেট টানছেন তিনি হয়তো সুদর্শন এক তরুণ, অথবা মাঝ বয়সী কেউ কিংবা ধরা যাক একজন তরুণী। সিগারেট তার মগ্নতায় মননে সবচেয়ে গুরুত্বের আসনে। তার ভালোলাগার ফাঁকে সিগারেট, বিরক্তির ফাঁকে সিগারেট, উচ্ছ্বাসে সিগারেট, উদ্বেগে সিগারেট, ক্ষুধায় সিগারেট, ভরপেট খাওয়ার পর সিগারেট, ঘুম থেকে জেগে সিগারেট, ঘুমাতে যাওয়ার আগে সিগারেট। সিগারেট নেই কোথায়? এ ভালোবাসার কোনো সীমানা নেই।
এই টান এতই টানটান যে, প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ শুনে বিমর্ষ মনে একটি সিগারেট জ্বেলে শোকভাবনার সঙ্গে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেহের ভেতর মহলে পাঠানোর মধ্যে এক ধরনের সুখ আছে। আবার বিশাল এক সুসংবাদ শুনে উচ্ছ্বাসে হৃদযন্ত্র যখন প্রসারিত তখন সিগারেটের গাঢ় ধোঁয়া এক অমৃতের সন্ধান মিলিয়ে দেয়। সিগারেটের ধোয়া ভুলিয়ে দেয় খাদ্যের টান, ভুলিয়ে দেয় পিপাসা; এমনকি ভুলিয়ে দেয় প্রেমও। সামান্য কাগজে মোড়ানো তামাকের কুচি পেছনে লাগানো একটি তুলোর ছাকনি যেন শতভাগ সুখ দিতে সক্ষম এক দণ্ড। এটি মুখে নিলে দুপাটি ঠোঁট আঁটো হয়ে আসে, মগজের জিপিএস তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে আর সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কল্পনার সমুদ্র। এই সমুদ্রতটে নিজেকে একবার ভেড়াতে পারলে যেন মিলে যায় অন্যরকম মুক্তি। যেকোনো চাপ থেকে সামান্য বিরতি পেতে এর বিকল্প আর কী হতে পারে?
কমলাপুর স্টেশনে একেবারে পাঁচ ছয় বছরের টিংটিঙে শিশুর মুখে সিগারেট দেখা যায়। দুই চোয়াল ভেতরে ঢুকিয়ে ওরা টান দেয়। ধোঁয়া ছাড়ে নাকমুখ দিয়ে। বড়রা শত অশান্তির ভেতর সিগারেট পেলে ফিক করে হেসে দিতে পারে। এক থালা ভাত কিংবা এক বোতল পানির চেয়ে এক প্যাকেট সিগারেট পেলে তাদের আর কিছু লাগে না। দেখা গেছে, যে কর্মকর্তা ধুমপায়ী, তাকে শুধু সিগারেটের কার্টন দিয়েই মনভোলা আর কার্যসমাধার রাজা বানিয়ে দেয়া যায়। আবার মাত্রাতিরিক্ত সিগারেটসেবীরা জীবনটাকে অতীবসুন্দর নাট্যমঞ্চ বানাতেও সমান পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তারা যেকোনো সময় যেকোনো চরিত্র ধারণ করতে পারেন। মুখ যেন প্রস্তুতি নিয়েই থাকে কিছু লোভনীয় বাক্য শোনাবার জন্য। সত্যকে যেমন গভীরভাবে উদ্ঘাটন করতে পারেন, মিথ্যাকেও বলতে পারেন সত্যের মতো। বলা যায়, এক ধরণের চাপ তাদেরকে চিন্তার এক অন্য স্তরে পৌঁছে দেয়।
ধূমপানের পক্ষে বিপক্ষে নানামুখি প্রচারণা বিশ্বব্যাপীই এক ধুম্রজালের সৃষ্টি করে। এ বছরের তথ্য হলো, বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ লোক ধূমপানজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে। আর এর ১০ শতাংশ লোক মারা যায় ধূমপান না করেও অর্থাৎ ধূমপায়ীদের কাছে বা সঙ্গে অবস্থানের কারণে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে পৃথিবীর ছয়টি বৃহৎ সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানির আয় ছিল ৩৪২ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি। জানা যায়, বাংলাদেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি, যার মধ্যে দেড় লাখের মতো কিশোর রয়েছে। আর ধূমপানজনিত ব্যাধিতে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ লোক মারা যায়। ২০১৫ সালে এই মৃত্যুর সংখ্যা বলা হয়েছিল আড়াই লাখ। ওই বছরই বেসরকারি সংস্থা এসইডি জানায় ধুমপানজনিত কারণে বছরে মারা যায় সাতান্ন হাজার মানুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ধূমপায়ীদের অর্ধেকই ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের। গ্লোবাল ইয়ুথ টোবাকো সার্ভের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ৭ শতাংশই তামাক ব্যবহারকারী। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫ বছরের ওপরে যাদের বয়স এমন ধূমপায়ীর হার দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২৫ দশমিক চার শতাংশ। আরেক তথ্যে দেখা যায়, ধূমপানের কারণে প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় হয়। এটি জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন। এতে আরো বলা হয়েছে, ধূমপানের কারণে ২০৩০ সালে বর্তমান সময়ের তুলনায় এক তৃতীয়াংশের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। তার মানে তামাকজনিত কারণে প্রতিবছর ছয় মিলিয়ন বা ষাট লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ২০৩০ সালে তা বেড়ে আশি লাখে দাঁড়াবে। এই মৃত্যুর শতকরা ৮০ ভাগের বেশি নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলিতে ঘটবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, মধ্য এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ ধুমপায়ীর বাস। যদিও বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কমছে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী ধুমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশে ধুমপায়ীর সংখ্যা কমছে। কিন্তু বছরান্তে হিসেবের বেলায় এই সংখ্যাটি কিন্তু পাকাপোক্তই পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যে চোখ আকাশে উঠে যাওয়ার যোগাড় হয়। গত বছর অক্টোরের একটি রিপোর্ট। রিপোর্টটি ক্রোয়েশিয়ার। তাদের দাবি, বিশ্বে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ক্রোয়েশিয়ার জনস্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ’ বিশ্বের ২২টি দেশের ধূমপায়ীদের উপর গবেষণা চালিয়ে এ তথ্য জানায়। গবেষণায় জানানো হয়, এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি ধূমপান করে থাকেন।
বিশ্বের স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবেই যে তথ্য প্রকাশ করুক না কেন, ধুমপায়ীরা এতে খুব বেশি বিচলিত হন না। এমনকি ধুমপায়ীদের কাছে এসব তথ্য মানে সময় আর অর্থের অপচয়, তার সঙ্গে রয়েছে কিছু বাণিজ্যিক গুটিচাল। সিগারেট হাতে নিয়ে বলতে ভালোই লাগে, হার্ট অ্যাটাকে যতজন মারা যান তার মধ্যে অধুমপায়ীর সংখ্যাই বেশি, ক্যান্সারে তো অধুমপায়ীরাই বেশি মারা যায়। অনেকের কাছে আছে ধর্মের দোহাই, আয়ু যতদিন লেখা আছে, তার একদিন আগেও কেউ পৃথিবী থেকে নিতে পারবে না। যতদিন আছি আরাম আয়েশে বাঁচি।
পোলাও মাংসের খানা ভরপুর খেয়ে একটি সিগারেট ধরালে যে আবেশ আসে, অথবা ঘন দুধচিনির এক কাপ চায়ের সঙ্গে একটা সিগােরেট এর মজা তো আর উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিশোর কুমার তো আর সাধে গান গাননি ‘সিগারেট নও তুমি, স্বেতপরী’। তাই বুক যতদিন ধোয়া গ্রহণ করতে পারছে ততদিন এই তৃপ্তি এড়িয়ে চলাটা বোকামি।
আসলে কি ধুমপানের মধ্যে এই মাত্রায় আরাম আয়েশ আছে? আমার নিজের উপলব্ধির কথা বলতেই হয়, ধুমপান ছেড়ে দেয়ার পর বুঝেছি, সিগারেটের কী ক্ষমতা। এই তামাককুচি পোরা সাদা নরম এক কাঠি পশ্চাতে তুলো নিয়ে কী ক্ষমতাই না দেখাতে পারে! দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ গ্রহণ, স্বাদ গ্রহণ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত অনুভবের জায়গাতেও সিগারেট তার ক্ষমতা দেখায়। সে রীতিমত একটি আবরণ সৃষ্টি করে সকল ইন্দ্রিয়ের সামনে। অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে সে অন্তত ৩০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণ আর ক্ষয়কারকের ভূমিকায় থেকে সে তার শক্তি বৃদ্ধি করেই চলে। একসময় সিগারেট জিতে যায়, হেরে যায় মানুষ।
সিগারেট ছেড়ে দেয়ার অন্তত এক বছর পর নিজেই বুঝেছি ঘ্রাণশক্তির শুদ্ধতা, নিঃশ্বাস নেবার নিজস্ব প্রবণতার সঙ্গে থাকতে পারাসহ আরো অনেক কিছু। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই শুদ্ধতা উপলব্ধি ও উপভোগের। বিজ্ঞান ঘেটেও দেখেছি সত্যিই তাই, মানুষকে বহুলাংশে খর্ব করে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে শত্রুর ভূমিকা রাখতে পারে সিগারেট। বিজ্ঞান বলছে, এক. সিগারেট সাময়িক মেজাজ ফুরফুরে করে দিলেও দীর্ঘমেয়াদী অবসাদ তৈরিতে সবচেয়ে সহায়ক, দুই. একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর ধুমপানের চাহিদা তৈরি হয়, পূরণ না করলে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়, তিন. চুল ও দাঁতের গুরুত্ব ভুলিয়ে দেয়, চার. খাবারের স্বাদ ও গন্ধ ফিকে করে দেয়, পাঁচ. দৃষ্টিশক্তিকে দুর্বল করে রাখে, ছয়. খাদ্যচাহিদা খর্ব করে দেয়, সাত. শরীরের চামড়ায় ভাঁজ ফেলে দেয়, আট. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
এগুলোর ফলাফল হিসেবে ধুমপান এমনই একটি আবেশ তৈরি করে যেখানে মানুষ তার স্বাভাবিক প্রকৃতি থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থান করে। যারা ধূমপানের করোনারি হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক, পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ ইত্যাদি রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাকে গায়ে মাখেন না, তারাও বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন, আপনার সবচেয়ে নিবিড়তম বন্ধুটি যখন জীবনের বড় একটি অংশের ক্ষমতাকে কেড়ে নিয়ে আপনারই সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন আপনি কি তার সঙ্গ ত্যাগ করতে চাইবেন না? একবারে এই সঙ্গ পরিত্যাগ কঠিন। তবে জীবনকে শত্রুমুক্ত করার তাগিদেই একদিন নিজের শক্তিতে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে দেখুন, জীবন কতটা শক্তির আধার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)