নানা রকম ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয়। ব্যবহারিক ভাষা, ব্যাকরণসম্মত ভাষা, তৃতীয় লিঙ্গের ভাষা, নৈঃশব্দের ভাষা, দেহকেন্দ্রিক ভাষা, ছাত্র পড়ানোর ভাষা, মুখ খারাপের ভাষা, মাস্তানি ভাষা, পাগলামির ভাষা, মায় সিনেমার ভাষাও। তবে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বিশেষ এক প্রতীক-নির্ভর ভাষা। যাকে বলা হয় ইমোজি। ‘ইমোজি’ শব্দটির উৎপত্তি জাপানি শব্দ ‘ইমোডজি’ থেকে। এর অর্থ ‘স্মাইলি’ অর্থাৎ ‘হাসিমুখ’। এটা মূলত ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসআপ, ভাইবার, ইমো ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ভাষা।
সমীক্ষায় প্রকাশ, ‘হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে’ বা ‘চোখে-জল-মুখে-হাসি’ এই অভিব্যক্তি-বাচক ‘ইমোজি’-ই এখন বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় ইমোজি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। তালিকার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে হার্ট এবং হার্ট আই ইমোজি।
২১২টি দেশ এবং অঞ্চলের ৪০ লাখ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর ৪২৭ মিলিয়ন মেসেজ নিয়ে এই গবেষণা চালানো হয়েছে। আর জরিপে দেখা গেছে, ‘চোখে-জল-মুখে-হাসি’ এই ইমোজিটির ব্যবহার ১৫.৪ শতাংশ। তবে ফ্রান্সে লাভ ইমোজি ব্যবহার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।
উল্লেখ্য, ইমোজি হলো একটি ক্ষুদ্র ছবি, যা মনোভাব বুঝায়। এটি মূলত ১৯৯০-এর দশক থেকে কম্পিউটারে বার্তা প্রেরণকারী মানুষের ব্যবহারের অঙ্গ, সেই ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমান সময়ে একটি পুরো বাক্য লেখার চেয়ে একটি ইমোজি অনেক বেশি অর্থ বহন করে। এমন কী ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে এই ইমোজি সেতুবন্ধনের কাজ করে।
২০১৫ সালে, অক্সফোর্ড ডিকশনারি তার ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই নির্দিষ্ট ইমোজিটিকেই নির্বাচন করেছিল এবং এই ধরনের একটি ছবিকে যে ‘শব্দ’ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া যায়, সেই সিদ্ধান্তে এসেও সকলকে বিস্মিত করেছিল। কিন্তু ছবিগুলি যদি মনোভাব বোঝাতে পারে, অন্য কোন চিহ্নের সাহায্য ছাড়াই, তবে এরা শব্দের কাজই তো করল। অক্সফোর্ড অভিধান বলেছিল, ‘চোখে-জল-মুখে-হাসি’ এই ইমোজিটি ২০১৫-য় সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে এবং ২০১৪-য় ইংল্যান্ডে এর ব্যবহার ছিল মোট ইমোজি ব্যবহারের ৪%, এক বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০%। আমেরিকায় এই বৃদ্ধি ৯% থেকে ১৭%। দেখা যাচ্ছে ইমোজিটি জনপ্রিয়তার ধারা অব্যাহত রেখেছে।
হয়তো মানুষ হাসতে এত ভালোবাসে, বা বার্তায় ‘হেসে খুন হচ্ছি’ ভাব দেখাতে এত ভালোবাসে, বা মূলত হাসির কথারই উত্তর দিতে ভালোবাসে, যে এই ইমোজিটি অন্যদের পেছনে ফেলে দিয়েছে।
ইমোজিগুলির জনপ্রিয়তার এক সম্ভাব্য কারণ এগুলোর সর্বজনবোধ্যতা, কারণ ভাষা না বুঝলেও ছবির ভাব বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। আবার এই ধরনের চিহ্ন ব্যবহার করলে, অনেকগুলো কথা লিখবার শ্রম থেকে রেহাই পাওয়া যায়, তাই সংক্ষেপে সব কিছু সেরে ফেলতে উদগ্রীব এই সভ্যতায় এদের জয়জয়কার হবেই। বহু সময় একটি মন্তব্যের উত্তরে কিছুই বলার থাকে না, বা বলতে ইচ্ছে করে না, তখন একটি স্মাইলি পাঠিয়ে দিলেই কাজও মেটে, ভদ্রতাও রক্ষা হয়- তেমন ভাবেই এই ইমোজিগুলো নিজেদের অপরিহার্য করে তুলছে। কারণ ডিজিটাল ভদ্রতা রক্ষা এবং দেখন-হাসি তো এই যুগে বাধ্যতামূলক।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, সর্বাধিক ইমোজি ব্যবহার করেন ফরাসিরা, অথচ তাদের মধ্যে এই নির্দিষ্ট ইমোজিটির রমরমা নাই। বরং তারা হৃদয়-আকৃতির ইমোজি ব্যবহার করিতে অধিক উৎসাহী। তাতে হয়তো বোঝা যায়, ফরাসিরা হৃদয়দৌর্বল্যে বেশি ভুগে থাকেন। এও প্রকাশ পেয়েছে, যে ক্লাশগুলোতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে অধিক মর্যাদা প্রদান করা হয়, সেইগুলিতে হাসিবাচক ইমোজির ব্যবহার অধিক। অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স এবং চেক রিপাবলিক এর বেশিরভাগ মানুষ হ্যাপি ইমোজি ব্যবহার করে। আর যে দেশগুলিতে বিভিন্ন গোষ্ঠী অধিক ঘনবদ্ধ, সেখানে বিষণ্ণতা, ক্রোধ এবং নেতিবাচক আবেগ-বাচক ইমোজি অধিক ব্যবহৃত। মেক্সিকো, চিলি, পেরু এবং কলোম্বিয়ার মানুষ দুঃখ, রাগ এবং নেগেটিভ অনুভূতির ইমোজি বেশি ব্যবহার করে।
এই সমীক্ষা থেকে আমরা কি এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারি: মানুষ একাকী থাকলে সুখে থাকে ও মিলে-মিশে থাকলে তার মধ্যে বিরক্তি ও দুঃখ অধিক উৎপন্ন হয়? বিবাহিত মানুষরা এই সিদ্ধান্তে সম্মত হয়ে প্রবল মাথা নাড়বেন ধরে নিয়েও বলা যায়, এমন উপসংহার টানলে বড়ই তাড়াহুড়া করা হবে। হয়তো অধিকাংশ মানুষই ইদানীং চারপাশের কথাবার্তা শুনে, বিশেষত ক্ষমতাশালী লোকের মতামত শুনে ও আস্ফালন দেখে, হাসবেন কি কাঁদবেন তা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন না। আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথা শুনলেও আমাদের অনুভূতি ওই ইমোজিটির মতোই। আজকালকার এই ইমোজি-অধ্যুষিত লিখনবিশ্বে, অন্তত এই ‘না আনন্দে না বিষাদে’ অবস্থাটি বোঝাবার ক্ষেত্রে, ‘চোখে-জল-মুখে-হাসি’ ইমোজিটির এক নতুন ব্যবহার সূচিত হতে পারে!
প্রশ্ন হলো, এই নিঃশব্দ ভাষা আমাদের শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ-প্রতিরোধহীন নির্বিষে পরিণত করবে নাতো?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)