নারী সাংবাদিককে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কোনো ক্ষমা নেই বলে মন্তব্য করেছেন নারী সাংবাদিকরা।
বৃহস্পতিবারে প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক প্রতিবাদসভায় এমন মন্তব্য করেন তারা। এই ধরনের কোনো অপরাধীরা যেন ক্ষমা চেয়েই পার পেয়ে না যায় সেজন্য আইন করার কথাও বলেন প্রতিবাদ সভায় অংশগ্রহণকারীরা।
আয়োজনে নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, নারীর চরিত্র রক্ষার দায়িত্ব আমরা কাউকে দিতে চাইনা। সেটা আমরা নিজেরাই পারি। এবং আমি বলতে চাই, এই আন্দোলনের পরে যাদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা জানি তাদের মুখোশ খোলা শুরু করব। এই ধরনের মন্তব্য যারা করে তাদের টকশোতে আনা উচিত না।
প্রতিবাদ সমাবেশে নিজের লেখা খোলা চিঠি পাঠ করেন নারী সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি। পুরো চিঠিটি এখানে দেওয়া হলো,
জনাব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন,
গত ১৬ অক্টোবর ২০১৮ রাত সাড়ে এগারটায় একাত্তর টেলিভিশনের জনপ্রিয় টক শো একাত্তর জার্নালে মিথিলা ফারজানার উপস্থাপনায় আমি এবং সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্ত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আপনার যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষাবধি আপনি আপনার বাসভবন থেকে ভিডিও সংযোগে অতিথি হিসেবে যুক্ত হন। টক শো’র চলমান আলোচনার প্রেক্ষিতে আমি আপনাকে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলাম যে, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যাতে আপনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য রাখছেন। অনেকেই এ কারণে মন্তব্য করেছেন যে, আপনি জামায়াতের প্রতিনিধি হিসেবে ঐক্যফ্রন্টে উপস্থিত থাকছেন… এটা কি সত্যি?”
অথচ এই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে আপনি আমাকে `চরিত্রহীন’ বলে ব্যক্তি আক্রমণ করেছেন এবং আমার সম্মানহানীর চেষ্টা করেছেন। যার মাধ্যমে আপনি আমার ব্যক্তি-মর্যাদা নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আপনি আমাকে ‘শিক্ষিতা ও ভদ্রমহিলা’র মতো ‘অন্য’ প্রশ্ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ কোন (ভদ্র) মহিলার এখতিয়ার নেই এরকম কোন প্রশ্ন করার। আপনি ধমক দিয়ে আঙুল উঁচু করে উচ্চস্বরে চোখ রাঙিয়ে আমাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
উপস্থাপক মিথিলা ফারজানা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করে আপনাকে সতর্ক করেছেন যে, একজন অতিথি আরেকজন অতিথিকে ব্যক্তি আক্রমণ তার অনুষ্ঠানের নীতি-বহির্ভূত এবং একেবারেই বেমানান। আমি যদিও তীব্রভাবে মনোক্ষুণ্ন হয়েছিলাম তবুও আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা এবং জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই অতিক্রমণের চর্চার কারণে আমার প্রফেশনাল কাজে আপনার বক্তব্যের কোনো প্রভাব পড়তে দেইনি। সে কারণে আমি আমার প্রশ্নে অটল ছিলাম এবং মানসিকভাবে কোনো দুর্বলতা আমি প্রকাশ হতে দেইনি কিংবা আপনাকেও পাল্টা আক্রমণ করিনি। আপনি চেষ্টা করেছেন আমার (মহিলার) ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার কিন্তু তাতে আপনি ব্যর্থ হয়েছেন।
আমার দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝেছি যে, যুক্তিহীন মানুষই সাধারণতঃ ব্যক্তিগত আক্রমণ করে এবং একজন নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি সব সময়ই তার চরিত্রকে নির্দেশ করেই এই আক্রমণ করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আপনিও তার ব্যক্তিক্রম নন। একাত্তর টক শোর উপস্থাপক মিথিলা ফারজানা আপনাকে বলেছেন যে, আপনি ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন এবং এটা তিনি মেনে নেবেন না। কিন্তু আপনি অত্যন্ত রূঢ় হয়ে পুরো অনুষ্ঠানে কথা বললেন এবং বরাবরের মতোই সেটা ছিল আক্রমণাত্মক।
একজন প্রবীণ আইনজীবী হিসেবেই শুধু নয়, আপনি ১/১১-র শাসনামলে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে আপনার আচরণ কি একজন প্রবীণ আইনজীবীর মতো ছিল? এই মুহূর্তে আপনি রাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট-এর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছেন, যারা একটি সুন্দর ও সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে চাইছে। কিন্তু একটি টেলিভিশন চ্যানেলে লাইভ অনুষ্ঠানে যে একজন সাংবাদিককে ‘চরিত্রহীন’ বলে গাল দেওয়া যায় না সেই বোধ যেমন সকলের মাঝে তৈরি হওয়া প্রয়োজন তেমনই ভবিষ্যতের বাংলাদেশে যাতে এরকম কোন কাজ কেউ না করে সেটাও নিশ্চিত করা সকল সচেতন নাগরিকের কর্তব্য।
এই মুহূর্তে বিষয়টি আর আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভের ব্যাপার নেই। কারণ, আমি মনে করেছি আমাকে বা যে কোনো নারীকেই এরকম আক্রমণের শিকার হয়েই এগুতে হবে। বিষয়টি এখন দেশের গণমাধ্যমকর্মীসহ সকল পেশাজীবী নারী ও সচেতন নাগরিকের ওপর আঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আঘাতকারী যখন একজন প্রবীণ আইনজীবী হয় তখন এটি আর আঘাত না থেকে হয়ে ওঠে চরম অপমানকর, অবমাননাকর ও আইনের লংঘনও।
গতকাল ১৭ তারিখ, বুধবার সন্ধ্যায় যখন আপনি আমাকে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করে ক্ষমা চাইলেন তখনই আপনাকে আমি একথা বলেছি যে, অন্যায় কাজটি আপনি করেছেন একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন টকশো-তে, যার স্বাক্ষী অনুষ্ঠানটির লক্ষ লক্ষ দর্শক। তাদের অগোচরে আপনি একটি ফোন করে ক্ষমা চাইলেন আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ক্ষমা করলেও যে অগণিত নারীকে আপনি অপমান করেছেন তাদের ক্ষোভ কোনোভাবেই তাতে প্রশমিত হয় না। যেহেতু বিষয়টি ঘটেছে জনসম্মুখে সেহেতু আপনাকে আপনার বক্তব্য প্রত্যাহারপূর্বক অপরাধ স্বীকার করে সকল পক্ষের কাছেই প্রকাশ্যে মার্জনা চাওয়াটা কাম্য।
আশা করি, আপনি আমার ও আমার মতো অসংখ্য নারীর সম্মানহানির ক্ষত-এর জায়গাটি উপলব্ধি করবেন এবং প্রকাশ্যে সকলের কাছে মার্জনা প্রার্থনা করবেন।
প্রতিবাদ সমাবেশে এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নী সাহা বলেন, এই প্রতিবাদকে নারীবাদি প্রেক্ষিতে না দেখে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাই। আপনারা যখন হেরে যাবেন তখন আপনাদের শেষ অস্ত্র আমাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে থাকেন। আমরা আমাদের কাজ করতেই থাকবো। তবে আপনারা যারা রাজনৈতিকভাবে কলঙ্কিত ও চরিত্রহীন তারা সাবধানে থাকবেন। রাজনৈতিকভাবে কলঙ্কিত ও চরিত্রহীনদের জন্যই আমাদের এই প্রতিবাদ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক নুজহাত চৌধুরী বলেন, টকশোতে যেভাবে কথাটা বলা হলো, সেভাবে কোনো মানুষ কোনো মানুষকে বলতে পারেন না। সেদিন যা ঘটেছে তা ক্লিয়ারলি একটা নির্যাতন। তিনি পেশাগত কাজ করছেন সেখানে কেন তিনি নির্যাতনের শিকার হবেন। এটাই প্রমাণ করে যে আমরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করি এবং মানসিকভাবে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব ধারণ করি। চরিত্র বিষয়টি খুব ধোঁয়াটে। এখানে খুন করলে বা এসিড ছুঁড়ে মারলে কেউ চরিত্রহীন হয়না। এমন কুরুচিপূর্ণ মানুষকে কোনো নেতৃত্বস্থানে দেখতে চান কিনা সেটা আমি প্রশ্ন রাখতে চাই।
জিটিভি ও সারাবাংলার প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, মইনুল হোসেনকে যখন বলা হলো, একজন অতিথি হয়ে আরেকজন সম্পর্কে এসব কথা বলতে পারেন না। তখনও তার অভিব্যক্তিতে দাম্ভিকতা ছিলো! এমন দাম্ভিক একজনকে আমি কোনো আয়োজনে ডাকতে চাই না। আমার বন্ধুদেরও বলেছি যেন তাকে ডাকা না হয়। তার কোনো প্রোগ্রাম আমরা কাভার করবো না। তিনি একজন গণশত্রু। তার ক্ষমা নেই। তার বাইরে কোনো শাস্তি থাকলে চিন্তা করতে পারেন।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির এই প্রতিবাদসভায় সংহতি প্রকাশ করেন।
এই ধরনের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে প্রতিবাদ সভায় আরো কিছু সমাধানের কথাও বলেন তারা। তার মধ্যে রয়েছে মইনুল হোসেনকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, ভবিষ্যতে এই ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে বিরত থাকবেন সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রতিবাদ সমাবেশে সংবাদিকদের আহ্বান জানানো হয় যেন তাকে কোনোরকম কাভারেজ দেয়া না হয়। এমনকি তাকে নেতৃত্বের স্থানে না রাখারও আহ্বান জানানো হয়।
তবে এই ঘটনায় মাসুদা ভাট্টিকে লিখিত চিঠিতে ক্ষমা চান ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।