প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের সূতিকাগার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সকল ধরনের সামাজিক ও নৈতিক আন্দোলেনের ফসল হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য অনন্য। আন্দোলনের অগ্রভাগে বিশ্ববিদ্যালয়টির নেতৃত্ব সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে অধিষ্ঠিত।
সম্প্রতি কোটা আন্দোলন নিয়ে সারাদেশব্যপী আন্দোলন ও মানববন্ধনের নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সবকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গঠনের কাজও সুচারুরূপে পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে, কোটা আন্দোলনের সময়কালীন সময়ে সংঘটিত বেশকিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা, পক্ষে বিপক্ষে মতামত ও আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকারি চাকুরিতে কোন কোটা থাকবে না মর্মে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় কোটা শীর্ষক আন্দোলন স্থগিত হয়েছে। কিন্তু আন্দোলন চলাকালীন সময়ে যে কটি বিরূপ ঘটনা ঘটেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পাবে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ, ফেসবুকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও পায়ের রগ কাটা শীর্ষক গুজবের ভাইরাল, ভিসি মহোদয়ের বাসভবনে হামলা ইত্যাদি খবরে সারাদেশে বিশেষ করে অনলাইনে তথা ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে যে ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ডিএমপি কমিশনার বলেছেন: প্রতিষ্ঠিত ক্যাডাররা সুপরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ সনদ ও নমুনা এ ন্যাক্কারজনক হামলার কারণে ধ্বংস হয়ে পড়েছে। যা আর কোনভাবেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কিন্তু হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এরকম ন্যক্কারজনক ঘটনা অবসানকল্পে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
ছাত্রদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনের সময় যে কোন ধরনের গুজব অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে, যার ফলে আন্দোলনের মৌলিকতা হারিয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। হাসপাতালে আহত অবস্থায় চিকিৎসারত ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ আন্দোলনের পরিস্থিতি ও ভয়াবহতা কতদূর নিয়ে যেতে পারে তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। মিথ্যা এবং বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনকারীদের যথাযথভাবে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি এবং জনরোষ সৃষ্টি হয়েছিল তার দায় মিথ্যা পরিবেশনকারী ব্যক্তিকেই নিতে হবে। ঐ ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, রাষ্ট্রকে অবশ্যই হীন চেষ্টাকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতেও এ রকম গুজব সৃষ্টিকারীরা তৎপর থাকবে।
আমার লেখার মূল বিষয় হলো নারী নির্যাতনের নতুন স্বরূপে বাংলাদেশের চিত্রায়ন নিয়ে। ঘটনাটি হলো: বিভিন্ন মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয় সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ইশরাত জাহান এশা আন্দোলনকারী এক ছাত্রীর রগ কেটে দেয়। খবরটি চাওর হওয়ার পরেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এশাকে বহিষ্কার করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এশার ছাত্রত্ব বাতিল করে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে হলের হাউস টিউটর ও অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, মেয়েটির পা কেটেছে কাঁচে। কোটা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে একজন ছাত্রীকে আঘাত করার খরব পেয়ে উত্তেজনার বশে সে ছাত্রলীগ সভাপতির কক্ষে পা দিয়ে লাথি মারলে কাঁচে তার পা কাটে। এখন পর্যন্ত এটাই খবরের সত্যতা। কেবলমাত্র পা কেটে যাবার কারণে হলের ছাত্রলীগ সভাপতিকে এতটা বর্বরতার মুখোমুখি হতে হবে? না এর পিছনে অন্য কোন গভীর ষড়যন্ত্রের জাল ছিল কিংবা অনেক দিনের চাপা ক্ষোভের বহি:প্রকাশ তা যথাযথ তদন্ত ব্যতিরেকে স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত কোটা প্রথা বাতিলের পরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত শেষে নির্দোষ প্রমাণিত এশাকে স্বপদে বহাল রাখে ছাত্রলীগ। অর্থাৎ এশাকে যে অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল সে অভিযোগের কোনরূপ সত্যতা পাওয়া যায়নি। তাই তাকে স্বপদে পুনর্বহালের নির্দেশনা আসে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে। কিন্তু আমরা যারা ভিডিওটি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেছি তাদের মনে নানামুখী চিন্তা ভাবনা উঠে আসে। দেখলাম, মেয়েটি কতটা ভীতস্বন্ত্রস্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের নিকট ক্ষমা চাচ্ছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রার্থিত ক্ষমার অবসান ঘটে জুতার মালা পড়ানো ও কাপড় ছেঁড়ার মাধ্যমে।
মেয়েটির কি অপরাধ ছিল? কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলনকারীকে নিজের রুমে ডেকে এনে নির্যাতন করা। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসন তাকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু সেই অপরাধের প্রেক্ষিতে মেয়েটিকে যেভাবে শত শত মেয়েদের সামনে ন্যাক্কারজনকভাবে অপমান করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আদৌ এমন কোন ঘটনা ঘটেনি।
মেয়েটি ছাত্রলীগের না হয়ে অন্য যে কেউ হলেও যারা মানবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে ভিডিওটি দেখেছেন, আমি নিশ্চিত মেয়েটির ভয়ার্ত চোখ আমাদের সকলকেই ব্যথিত করেছে। প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যে মেয়েরা এশাকে এহেন ঘৃণিত নির্যাতনের মুখোমুখি করেছে তাদের মেধা, যোগ্যতা এবং মানবিকতাবোধ নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে।
কিছু উৎসুক মেয়েরা যেভাবে মেয়েটিকে জুতার মালা পরিয়েছে, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঘটনার সাথে সাথে যেভাবে জুতার মালা প্রস্তুত করা হয়েছে, মনে হয়েছে বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত। এই প্রথম বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একদল মেয়েরা তার সহপাঠীকে জঘন্য উপায়ে জুতার মালা পড়িয়ে দিয়েছে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা সকলেই সচেতন ভাবে দাঁড়িয়েছি এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকার সহ প্রতিনিধিত্বশীল মানুষজন বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন। সেখানে যদি একজন নারী অন্য নারীকে পৈশাচিক উপায়ে, আদিম যুগের ন্যায় নির্যাতন করে থাকে সেখানে পিছিয়ে পড়া সমাজগুলোতে নারী নির্যাতনের স্বরূপ প্রকাশ্যে চলে আসবে জঘন্যভাবে। বিষয়টা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয় তাহলে পরিবর্তন আদৌ সমাজে এসেছে কিনা সে বিষয়েও সন্দিহান আমি।
পাশাপাশি নামসর্বস্ব বিভিন্ন মিডিয়া মেয়েটির ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নিয়ে মুখরোচক আলোচনা করে যাচ্ছে জঘন্যভাবে। বিষয়টি মোটেই সুখকর নয়। কারণ এমন একটা ভয়াবহ নির্যাতনের পরে মেয়েটির মানসিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি একবার বিবেক দিয়ে অনুধাবন করা উচিত। আমরা কি নিজেদের বোন কিংবা মেয়ে হিসেবে এশাকে কল্পনা করতে পারি না। তাহলেই ঘটনার ভয়াবহতা ও নৃশসংতা সম্বন্ধে অবগত হওয়া সহজ হবে।
জুতার মালা পড়ানোর সাথে সাথে একজন মেয়ে অন্য মেয়ের কাপড় খুলে নিচ্ছে এবং সেটি ভিডিও আকারে ভাইরাল হচ্ছে বিষয়টি কতটা ঘৃণিত তা একবার ভবে দেখেছেন। একজন মেয়ে কিভাবে অন্য মেয়ের কাপড় খোলার দৃশ্য ভিডিও ধারণ করে। শুধু কি ভিডিও ধারণ করেই ক্ষান্ত হয়েছে কুচক্রিমহল, ভিডিওটি ভাইরাল করে জঘন্য ভাষায় মেয়েটিকে আক্রমণ করা হয়েছে। আসলে আমরা কোথায় চলে যাচ্ছি? আমাদের নীতি নৈতিকতা ও বিবেক কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? একটা মেয়েকে পাশবিক নির্যাতন করা হচ্ছে অথচ আমরা আরও সে ঘটনায় উসকানি প্রদান করে মদদ দিচ্ছি। ফেসবুকে মেয়েটাকে নিয়ে আরও নোংরা বাণী ছড়ানো হচ্ছে।
এখন আবার শুরু হচ্ছে মেয়েটার পরিবার নিয়ে ব্যাখ্য বিশ্লেষণ, বিষয়টা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিদঘুটে। তবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাক্তন সদস্যের ধন্যবাদ দিতে হয়, তারা অনেকেই নির্যাতিত এশার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মেয়েটাকে মানসিকভাবে প্রশান্তি দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাচলের জন্য সমাজে নিয়ে আসা সকল বিবেকবান মানুষের দায়িত্ব। ভবিষ্যতে যেন কোন মেয়েকে এশার মতো নির্যাতনের শিকার হতে না হয় সে বিষয়েও সকলেই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নারীদের সুরক্ষার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)