চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নারীর জীবনের বঞ্চনার গল্প শুরু হয় শৈশব থেকে

বাবা মায়ের বড় চিন্তা শম্পাকে নিয়ে। আর বোনদের মত নয় সে। ঘরে তারা ৫ বোন ১ ভাই। শম্পা শুনেছে ছেলের আশায় পর পর ৫ বোনের জন্ম। মেয়েদের কোন মতে বিয়ে দিয়ে পার করতে হবে মা বাবার এমন মানসিকতা শম্পা দেখেছে ছোট বেলা থেকে। বাবা মায়ের অবহেলার মনোভাব নিয়ে ৫ বোন যেন, ‘ আপন ঘরে পর মানুষ’।শম্পার বড় বোন শ্বশুর বাড়িতেও অবহেলিত। কিন্তু মাকে বলা যায় না এসব কথা। বললেই বলবে, ‘ মেয়েদের সহ্য করতে হয় এসব।’ কিন্তু কত সহ্য করবে মেয়েরা আর।
এ সমাজে নিজের বাবা মা মেয়েকে ছোট বেলা থেকে দিতে পারে না সম অধিকার। ছেলেকে সব কিছুতে প্রাধান্য দিয়ে বড় করে। আসলে একটা মেয়ের বঞ্চনার গল্প শুরু হয় জন্মের পর তার নিজ পরিবার থেকেই। ছেলেকে যত্নশীল করে মানুষ করে। কারন সে বংশের প্রদীপ। আর মেয়ে যতই শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত হোক, সে বিয়ের পর স্বামীর ঘরে যাবে। এ ঘর তার নিজের নয়।অবহেলা, বঞ্চিত, পরাধীনতা শব্দ গুলো মেয়েদের জন্য সব সময় প্রযোজ্য।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের নারীদের জন্য রেখেছে সকল অধিকার, সুযোগ সুবিধা। যেমন সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার রয়েছে। ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা। ২৮ (১) অনুচ্ছেদে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যে প্রদর্শন না করা এবং ২৮ (২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও গণ-জীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের “সমান অধিকার” লাভ করার কথা বলা আছে ।
সংবিধানের এ ধারাগুলো কেবল সাদা কাগজে কিছু কালো শব্দ। সামাজিক জীবনে নারীরা এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত । সে হোক বাবার পরিবারে বা স্বামীর পরিবার। একই পরিবারের ছেলে মেয়ের সকল চাওয়া পাওয়া সমভাবে পূরণ করার কথা। কিন্তু তা হয় না। ছেলেকে আত্ননির্ভরশীল করে তোলার পাশে মেয়েকে বলা হয় পরনির্ভরশীলতার কথা। আধুনিক সমাজে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভংগি পরিবর্তন হয়েছে বলা হয়ে থাকে৷ তবে পরনির্ভরশীলতার মনোভাব দূর হয়নি। আর সে কারণে এদেশে হাজারো নারী উচ্চ শিক্ষিতা হয়েও নিজের অধিকারের কথা বলতে পারে না। তারা পড়ালেখা করে প্রস্তুত হয় বিয়ের জন্য। যদি কোন কারণে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে, তখন নিজের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। মানুষের কটুক্তি আর চলার মত জীবিকার পথ খুঁজে দিশেহারা হয়। এমনকি জন্ম দাতা পিতার ঘরকে নিজের ঘর বলে দাবি করে যেতে পারে না সহজে।
অন্য দিকে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়েও অনেক নারী বঞ্চনার শিকার হয় মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনের মাধ্যমে । প্রকৃতপক্ষে একজন নারী অসম অধিকার শব্দটি নিয়ে ছোট থেকে বড় হয় পিতার ঘরে৷ সে পিতার সম্পত্তিতে ন্যায্য অধিকারটা পাবে কি পাবে না তা আইনের চেয়ে বেশি নির্ভর করে বাবা মায়ের ইচ্ছার উপর।
আবার বিয়ের পর একজন মেয়ের জীবনের সব কিছুতে পরিবর্তন আসে। সেখানে স্বামীর ঘরটাকে নিজের বলে দাবি করার আগে তা হয়ে যায় ছেলের ঘর৷ স্বামীর আজ্ঞাবহ জীবন তার নিজের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। সেখানেও মা বাবার কথার প্রতিচ্ছবিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। আর সারা জীবন কম্প্রোমাইজ করতে গিয়ে কতটা বঞ্চিত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আসলে নারীর জীবনে অধিকার চেয়ে বঞ্চনা শব্দটি নীরবে বয়ে যায় প্রতিমুহূর্তে। আর এ বঞ্চনা যে কেবল পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক অবস্থার কারনে হয় তা কিন্তু নয়। নারীই নারীকে বঞ্চিত করে। মা মেয়েকে নিজের জীবন থেকে শিক্ষা দেয় না। বরং অজ্ঞতা বা জানার ভুলে পুরুষের শাসিত সমাজে মেয়েকে চলতে অভ্যস্ত করে। কারণ সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এখনো অবধি নারীর প্রতি পরিবারের বঞ্চনার মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারেনি। আজও পিতার কাছে কন্যা সন্তান অভিশাপ। যৌতুকের কারনে নারী হয় নির্যাতিত। নিরাপত্তাহীনতা ঘরের বাইরে। নারীর প্রতিবাদকে ‘ অতি আধুনিকতা বা নারীবাদি ‘ বলে দমিয়ে রাখে নিজ ঘরের মানুষ।
সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে বলে জীবনের প্রয়োজনে নারীর বঞ্চনার গল্প বদলে যাচ্ছে না। এ সমাজ একটা মেয়ে আর ছেলে সমান তা মেনে নিতে পারে না। আর সে কারণে নারীর বঞ্চনার গল্প শম্পাকে ক্ষত বিক্ষত করে প্রতিনিয়ত। সে চাইলে ও বলতে পারে না মা বাবাকে, আমিও ভাইয়ের মত এ পরিবারের একজন। নিজ পরিবারের থেকে প্রাপ্য অধিকার পেলেই নারী পথ চলাতে সত্যিকারভাবে আত্মনির্ভরশীলতা আসবে সকলভাবে।

 

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)