চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নারীদিবস-আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক অচলায়তন

প্রায় সাড়ে চার দশক আগে মার্কিন লেখিকা গ্লোরিয়া স্টাইনেম ‘ইফ মেন কুড মেনস্ট্রুয়েট’ নিবন্ধে লিখেছিলেন: ছেলেদের যদি মেনস্ট্রুয়েশন হত! তারা মাসের ক’দিন কুণ্ঠায় ভরে থাকত না। বরং পৌরুষের সূচনা নিয়ে সগর্বে গলা ফাটাত। সেনাধ্যক্ষ, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মগুরুরা বিবৃতি দিতেন: পুরুষরাই দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে পারে। মেনস্ট্রুয়েশনের রক্তদর্শন নেই, মেয়েরা আক্রমণাত্মক হবে কী ভাবে? পরিসংখ্যানবিদেরা প্রমাণ করতেন, মাসিকের সময়েই ছেলেরা বেশি অলিম্পিক পদক জেতে।

উল্লিখিত মন্তব্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে কোন মূল্যে পুরুষদের মহিমান্বিত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের রীতিকেই লেখিকা ব্যঙ্গ করেছেন। ব্যঙ্গবিদ্রূপ আমরা যতই করি না কেন, সমাজে পুরুষের ক্ষমতা-দাপট-আধিপত্য কিন্তু তাতে কমে না। বরং পুরুষতন্ত্র নানা কৌশলে অক্টোপাশের মত নারীকে যেন চারদিক থেকে চেপে ধরে রাখছে!

নারী এগিয়েছে, এগোচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতায়ন কী ঘটছে। ভেতরের সমস্যাগুলো কী কাটছে? নারী-পুরুষের মধ্যে পুর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য, প্রত্যেকের বেঁচে থাকার সমান অধিকার, সমান কোয়ালিটি অব লাইফ-এটাই হচ্ছে ক্ষমতায়ন। সেই ক্ষমতায়নের পথে নারীরা এখনও প্রান্তিক। নারী পুরুষ সবাইকে নিয়েই মানুষের সভ্যতা।

কিন্তু লিঙ্গ-রাজনীতি তাকে খর্ব করেছে। ‘পৌরুষের’ জোরে পুরুষরা নারীর উপর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। নিজেদের স্বার্থ-সুবিধা-লোভ চরিতার্থ করতে নারীর উপর আরোপ করছে নিত্যনতুন অভিমত, বিধিব্যবস্থা।চালাচ্ছে অত্যাচার নির্যাতন। একথা ঠিক যে, ক্ষমতা এক্ষেত্রে একটি বড় নিয়ামক শক্তি।অর্থনৈতিক, সামাজিক ভাবে দুর্বল ছেলেদের ওপরেও ছেলেরা অত্যাচার চালায়।

সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নারীপুরুষ সম্পর্ককে আরও উন্নত স্তরে স্থাপন করা। নারী ও পুরুষ অবশ্যই দুটি স্বাধীন সত্তা। কিন্তু এই দুটি স্বাধীন সত্তা একে অপরকে বাদ দিয়ে থাকতে পারে না, প্রয়োজন যথার্থ পরস্পরনির্ভরতা। ইন্ডিপেন্ডেন্সই শেষ নয়, ভাবতে হবে ইন্টারডিপেন্ডেন্স নিয়েও।

নারীরা এখনও নির্যাতিত। ধর্ষণ যেন মহামারি।কারণ পুরুষ নারীকে এখনও শুধুই প্রজননের জরায়ু-যন্ত্র হিসেবে দেখছে। পুরুষতন্ত্র মানে সেই প্রজনন-যন্ত্রের ওপর প্রভুত্বের ইচ্ছা। এক দল লোক আছে, যারা যৌনতার মুখ্য উদ্দেশ্য বলতে শুধু সন্তান উৎপাদন ভাবে। ছকে মেলে না বলেই এরা মেয়েদের স্বাধীনতা, গর্ভপাত, সমকামী আন্দোলন, সব কিছুর বিপক্ষে। প্রজনন-নির্ভর যৌনতার দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে সরিয়ে আনতে হবে। ঘটাতে হবে সমাজ-মানসের পরিবর্তন। আর নারী আন্দোলনকেই এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।

নারী আন্দোলনের অনেক দায়িত্ব আছে।নারী আন্দোলন মানে শুধু নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে পোস্টার-লিফলেট ছাপানো বা ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে মিছিল নয়। এসবের প্রয়োজন আছে। তবে এর পাশাপাশি গ্রামে মায়েদের স্বাস্থ্যের উন্নতি, প্রসূতির মৃত্যুহার কমানোর ব্যাপারে সমাজকে সচেতন করা, রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করার কাজটিও গুরুত্ব দিয়ে করা দরকার। নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী চলা ইত্যাদিও বড় সমস্যা।

এখনও আমাদের সমাজে মেয়েদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার আর ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের আধিক্য। গ্রামের গরিব মেয়েদের সেই চিকিৎসার উপকরণ সরবরাহ করার দাবি তোলাও নারী আন্দোলনের কর্তব্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের নারী যতই তার শৃঙ্খল ভেঙ্গে অগ্রসর হোক, ‘নারীত্ব’ বিষয়ে আমাদের সমাজের ধারণা কিন্তু সমগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে না। নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের অবিচ্ছিন্নতায় যেমন তার প্রকাশ, নারীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগের পরিমাণ(যেমন নারীর সামর্থ্য, পোশাক, চলাফেরা ইত্যাদি)হু-হু করে বেড়েযাবার মধ্যেও তা স্পষ্ট।

কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পদগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে নারীরা নেতৃত্ব প্রদান করলেও নারী সম্পর্কে দেশের বেশিরভাগ মানুষের বদ্ধমূল নেতিবাচক ধারণা খুব একটা পরিবর্তিত হচ্ছে না। ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হলে এখনও সমাজে নারীকেই চোখ বন্ধ করে দায়ী করা হয়, দোষী সাব্যস্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠানে ধরাবাধা কিছু আলঙ্কারিক পদ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীকর্মী নিয়োগ দিলে এখনও একশ্রেণির মানুষ অসন্তুষ্ট হন।

সুযোগ থাকলে এসব নিয়োগে তীব্র অনীহা প্রকাশ করেন। মন থেকে এখনও অনেক পুরুষই নারীর নেতৃত্ব, গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীর অধিষ্ঠান কিংবা সিদ্ধান্ত প্রদানকারীর ভূমিকায় দেখতে চান না। এই মানসিকতা কোন আকস্মিক প্রতিক্রিয়া-মাত্র নয়, বরং এই অস্বস্তি, আশঙ্কা ও অনীহার উৎস গভীরতর।

সমাজে সচেতনতা বাড়লেও নারীর প্রতি বিরুদ্ধমত এখনও তীক্ষ্ণই রয়ে গেছে। এ ভাবে দুই লিঙ্গের মানুষের মধ্যে দূরত্ব যত বাড়বে, ‘নারীত্ব’আরও সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হবার আশঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই দেখা যায়, পুরুষ তাঁর সহকর্মী নারীর ‘নারীত্ব’ বিষয়ে যত বেশি সতর্ক ও সচেতন হন, নারীও পুরুষের সমকক্ষ হবার জন্য ‘পুরুষালি’ হবার প্রয়োজন অনুভব করেন। তবে কি সত্যি আমাদের সমাজ-মননে ‘নারীত্ব’ বিষয়টি অধিকতর সংকটময় হয়ে উঠছে? নারীত্বের সঙ্গে স্বাভাবিক নিরপেক্ষ সহাবস্থানের সম্ভাবনা সুদূরতর হচ্ছে? বিষয়টি গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকার।

অথচ, নারী-অধিকার ও নারী-সক্ষমতা এলেই নারীত্বের ধারণা আপনা-আপনি দ্রুত পাল্টাবে, এই ছিল সাধারণ ধারণা। পশ্চিমি অভিজ্ঞতা থেকেই এই প্রত্যাশা সঞ্জাত। পশ্চিমি সমাজে এত দিন পরেও নারীত্ব-সংক্রান্ত সংবেদনশীলতা যে কত প্রখর, বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মস্থলের মতো গণ-প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বিষয়ে সচেতনতা কত গভীরচারী, তা আটকাবার জন্য সেখানে নিয়মিত কত নজরদারি, তা খেয়াল করা হয় নাই।

যে কোনও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী বা নারীকর্মীর সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যতামূলক রীতি মানতে হয়, এখানে তেমন কিছু ভাবাই হয় না। এখানে ধারণাটি এমন যে, তারা যদি লাফে লাফে এগোতে পারে, আমরা পারব না কেন?

মনে রাখা দরকার, সামাজিক অভিযোজন সব সময় এক পথ ধরে চলে না। এর জন্য প্রস্তুতি লাগে। মেনে নেবার, মানিয়ে নেবার, খাপ খাওয়ানোর জন্য সমাজকে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত করতে হয়। একটি বিশেষ অভিযোজনের জন্য এক এক সমাজে এক এক রকম সময় লাগতে পারে। পশ্চিমে নারী-অধিকার ও নারী-মুক্তি যে ভাবে এগিয়েছে, আমাদের এখানে সে পথ ভিন্ন হওয়াটাই প্রত্যাশিত। আমাদের সামাজিক প্রত্যাশা আলাদা, পারিবারিক রীতি-বিধি আলাদা।

পশ্চিমে আঠারো বৎসরোর্ধ্ব সন্তান একাকী পরিবার-সীমার বাইরে দিননির্বাহ করে। এ দেশে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান, বিশেষত কন্যা-সন্তান, পারিবারিক গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে, বিবাহ-পূর্ব কিংবা বিবাহ-পরবর্তী, দুই পরিস্থিতিতেই। ফলে কন্যার মানসিক অভিযোজন ও কন্যা সম্পর্কে পরিবার তথা সমাজের অভিযোজন, দুই-ই তদনুসারে চালিত হয়। আধুনিক শহুরে বৃত্তিজীবী সমাজেও দেখা যায়, বহু মানুষ একাকী কোনও নারীর সঙ্গে ঠিক কোন ব্যবহারটি করা উচিত, আর কোনটি নয়, সে বিষয়ে সচেতন নন।

বিপরীতে, অনেক নারীও নিরাপত্তা ও আত্মসম্মান বজায় রেখে কী ভাবে পেশাগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চালনা করতে হয়, সচেতন নন। ব্যতিক্রম আছেই। আছে বলেই আমাদের দেশে নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণির নারীর পক্ষে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ব্যতিক্রম-ই পরিস্থিতির প্রধান পরিচায়ক নয়। সামগ্রিক ভাবে পেশাগত ক্ষেত্রে নারীকর্মী, সহকর্মী, ছাত্রী, প্রশিক্ষণার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক-রচনার শিল্পে আমাদের সমাজ এখনও প্রারম্ভিক পর্বেই আটকে আছে, নাকানিচোবানি খাচ্ছে।

এসব ক্ষেত্রে আমাদের নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। নারীদিবস নারীর জন্য, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্ধারিত একটি বিশেষ দিবস। দিবসটি প্রতি বছর নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠারও ডাক দিয়ে যায়। কাজেই নারীদিবস হতে পারে আমাদের আগামী দিনের করণীয় চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার শপথ উচ্চারণের দিন।

পুনশ্চ: সেক্স ওয়ার্কার বা যৌনকর্মী শব্দটি কী আমরা পরিহার করতে পারি না? যৌনকর্মীরা কিন্তু স্বেচ্ছায় নয়, দায়ে পড়ে যৌনতা বিক্রি করেন। এদের বেশির ভাগই অভাবী, পাচার হয়ে-আসা মেয়ে, শ্রমিকের অধিকার নেই। ফলে শব্দটি ঠিক তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয় না। পশ্চিমে অনেকে নারীবাদী ‘প্রস্টিটিউটেড উইম্যান’ লিখছেন। অর্থাৎ যে প্রস্টিটিউশনের মধ্যে এসে পড়েছে। এই শব্দের বাংলা সম্ভব? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুযায়ী বেশ্যা শব্দটি সংস্কৃত থেকে আসা মূল তৎসম শব্দটি আদৌ স্ত্রীলিঙ্গবাচক নয়: বেশ্য। যৌনকর্মীকে বিসর্জন দিয়ে বেশ্যিত নারী/পুরুষ বললে কেমন হয়?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)