শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ঘটনার শুরুতে বলেছিলেন যে, এমপি সেলিম ওসমান তাঁর জীবন রক্ষা করেছেন এবং এজন্য তাঁর কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। সেলিম ওসমান সেদিন ঘটনাস্থলে না গেলে হয়ত তিনি জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারতেন না বলে জানিয়েছিলেন শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। সেলিম ওসমানকে তাঁর ভগবান বলে তখন উল্লেখ করে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত সেলিম ওসমানের কাছে চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য অনুরোধও করেছিলেন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া এক অডিও থেকে জানা যায় যে, সেলিম ওসমান তাঁর চিকিৎসার জন্যও সহযোগীতার কথা বলেন এবং শিক্ষক শ্যামল ভক্তের আগের চাকরি ফিরে না পেলে ওসমান সাহেবের নির্মিত একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকতার জন্য তাঁকে প্রস্তাব দেন। (https://www.youtube.com/watch?v=6dS…)
একথা বলার দুই-তিনদিন পরেই কোন এক অজ্ঞাত কারনে তিনি তাঁর পূর্বের বক্তব্য থেকে সরে আসেন এবং সেলিম ওসমান কর্তৃক তার দু’গালে থাপ্পড় মারার কথা বলেন এবং কানে ধরে ওঠবস করতে সেলিম ওসমানের আদেশের কথা বলেন। সাংবাদিকদের কাছে তিনি এমপি সেলিম ওসমানের উপযুক্ত বিচারও দাবি করেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, দুই-তিন দিন পূর্বে তিনি সেলিম ওসমানের ভয়ে এই কথা বলতে পারেননি, যা তিনি এখন নির্ভয়ে বলতে পারছেন। অর্থাৎ প্রথমে তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য সেলিম ওসমানের প্রতি যে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন, পরে তা প্রত্যাহার করে তাঁকে নির্যাতন ও অপমানের জন্য সম্পূর্ন সেলিম ওসমানকে দায়ী করে তাঁর বিচার কামনা করেন।
ছাত্র মো: মৃদুল যে কথা শুরুতে বলেছেন যে, হেডমাস্টার ধর্ম নিয়ে কোনো কটাক্ষ করেনি, সেই মৃদুলই এখন আবার নির্ভয়ে বলছে যে, স্যার আল্লাহকে গালি দিয়েছে। হেফাজতের মিটিংয়ে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে মো: মৃদুল শ্যামল স্যারের বিচার দাবি করছে।
এখানে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত এবং ছাত্র মোঃ মৃদুলের মধ্যে যে সামঞ্জস্যতাগুলো রয়েছে, তা হলোঃ
(১) তাঁরা দুজনেই ঘটনার প্রধান চরিত্র।
(২) তাঁরা দুজনেই ঘটনার দিন একধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
(৩) তাঁরা দুজনেই পরে নিজ অবস্থান থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য প্রদান করছেন।
(৪) তাঁরা দুজনেই ঘটনার শুরু থেকে বিভিন্ন কারণে ভীত ছিলেন।
(৫) বর্তমানে তাঁরা দুজনেই সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়ে সম্পূর্ন নির্ভয়ে কথা বলতে পারছেন।
(৬) সাহস যোগাতে সম্পূর্ণ খোলাখুলি এবং ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের দু’টি গোষ্ঠী তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ঘটনার সুনির্দিষ্ট মেরুকরণও করা হয়েছে।
(৭) তাঁরা দুজনেই এখন বিচার চাইছেন, বা তাঁদের দিয়ে চাওয়ানো হচ্ছে। একজন চাইছেন শ্যামল স্যারের, আর একজন চাইছেন সেলিম ওসমানের, যা তাঁরা আগে চাননি।
অর্থাৎ উপরের ১-৭ নাম্বারের পয়েন্টগুলো এক্ষেত্রে একটা বিষয়ই স্পষ্ট করে যে, শুরু থেকেই ঘটনার পেছনের মূল নায়করা পর্দার আড়ালে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই মূল খেলাটি পরিচালনা করেছিলেন একটা ভিন্ন রূপ দেয়ার জন্য।
খোলা চোখে এখন পর্যন্ত খেলার ফলাফলে দেখা যায় যে, সেলিম ওসমান বেশ পিছিয়ে আছেন এবং তাঁর স্বপ্রণোদিত ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মৌলবাদী হেফাজতে ইসলাম। অথবা কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, একটি পক্ষ “শামিম ওসমানের ভাই” সেলিম ওসমানকে ওই পথ বেছে নিতে যেতে বাধ্য করেছে ঘটনায় ভিন্ন রং চড়াতে।
এখানে উল্লেখ্য যে, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ফলাফল ইতিপূর্বে অনেকবারই অমিমাংসীত ছিল এবং এবার তা একটা সম্ভব্য মীমাংসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যেকোন এক পক্ষ বিজয়ী হিসেবে মাঠে থাকছেন বলেও অনুমান করা যায়। মাঠে টিকে থাকার জন্য এবং বাঁচামরার লড়াইয়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য যেকোন পদ্ধতিই দুপক্ষ অবলম্বন করছে এবং করবে বলেই আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। তাতে কোন পক্ষ “জাত-পাত” মানবে বলে মনে হচ্ছে না।
ঘটনার দিন একপক্ষ মাইক ব্যবহার করেছে, তারপর থেকে একটি পক্ষ মিডিয়া ব্যবহার করে চলেছে। অর্থাৎ শ্যামল কান্তি ভক্ত এবং মো: মৃদুলকে মূলত দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে অমীমাংসিত একটি খেলার ফলাফলকে অন্তিম একটি মীমাংসার দিকে বেশ তড়িৎ গতিতেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে নারায়ণগঞ্জের কুশীলবরা।
ভুলে গেলে চলবে না যে, বিশ্ব রাজনৈতিক মানচিত্রে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্ব যে কারণে খুব বেশি, ঠিক একই কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে নারায়ণগঞ্জের অবস্থানও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনীতির মাঠে নারায়ণগঞ্জের দখলদারিত্বের উপরে ভিত্তি করে জাতীয় রাজনীতির দিক নির্দেশনা হয়েছে বহুবার এবং আগামীতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এক পক্ষকে হারাতে গিয়ে যে মূল্য দুই পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্ধারন করে চলেছে প্রতিনিয়ত, নিকট ভবিষ্যতে তার সুদে-আসলে চড়া মূল্য হয়ত দিতে হবে বর্তমান সরকার সহ সারা জাতিকে। সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তার ষোল আনা সুবিধাভোগী হবে যে জামায়াত-হেফাজতসহ অন্যান্য মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো, তা না বোঝার মত নালায়েক নিশ্চয়ই নারায়ণগঞ্জবাসী নয়। জাতি একারণে আপনাদের সুচিন্তিত ও প্রজ্ঞাপূর্ন সিদ্ধান্তই আশা করবে একটি সুন্দর আগামীর জন্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)